ডেঙ্গু পরবর্তী রোগীর পরিচর্যা ও আমাদের করনীয় করনীয়

Spread the love

ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর যে বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা হয় তা থেকে শরীর দুর্বল হয়ে যায়। ডেঙ্গু থেকে নিরাময় লাভের পরও শরীর দুর্বল থাকে৷ আর এই সময়ে দ্রুত শরীর সবল করার জন্য খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। একাধিক পর্যবেক্ষণে জানা গেছে, দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে আরও ভয়াবহ হয়। সেজন্যই কিছু বিষয়ে সতর্ক থেকে ডেঙ্গুর পর ভালো অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। ডেঙ্গু থেকে সুস্থ হলে যেসব বিষয়ে সতর্ক হবেন সে বিষয়ে পরামর্শ আপনাদের জন্য নিবেদন করছি।

ডেঙ্গু জ্বর একটি এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস জনিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সাধারণত ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। উপসর্গগুলির মাঝে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ও গাঁটে ব্যথা এবং গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি। দুই থেকে সাত দিনের মাঝে সাধারণত ডেঙ্গু রোগী আরোগ্য লাভ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রক্তক্ষরী রূপ নিতে পারে যাকে ডেঙ্গু রক্তক্ষরী জ্বর (ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার) বলা হয়। এর ফলে রক্তপাত হয়, রক্ত অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্ত প্লাজমার নিঃসরণ ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কখনোবা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখা দেয়। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়।

কয়েক প্রজাতির এডিস মশকী (স্ত্রী মশা) ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। যেগুলোর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি মশকী প্রধানতম। ভাইরাসটির পাঁচটি সেরোটাইপ পাওয়া যায়। ভাইরাসটির একটি সেরোটাইপ সংক্রমণ করলে সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে রোগী আজীবন প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে, কিন্তু ভিন্ন সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সাময়িক প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে।পরবর্তীতে ভিন্ন সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমিত হলে রোগীর মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। কয়েক ধরনের টেস্টের মাধ্যমে, যেমন, ভাইরাসটি বা এর আরএনএ প্রতিরোধী এন্টিবডির উপস্থিতি দেখেও ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয় করা যায়।

ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার পর করণীয়

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই সময়কে Convalescent periodলে। এই সময় ধীরে ধীরে শরীর ও মন পুনর্গঠন হয়, যাতে সপ্তাহখানেক বা কারো ক্ষেত্রে মাসখানেকও সময় লাগতে পারে। বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস, কিডনি, শ্বাসরোগ বা অন্য কোনো রোগ থাকে, তাদের বেলায় কিছু বেশি সময় ধরে চলে। শরীর পরিপূর্ণভাবে গড়ে ওঠে বলে এই সময়ে কাজের মাত্রা বা চাপ তাড়াতাড়ি আগের মাত্রায় বাড়ানো ঠিক হবে না; বরং ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে।

দু-তিন সপ্তাহ সময় নিন

ডেঙ্গুকে ঝড় ও সাইক্লোনের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ঝড় ও সাইক্লোন হলে যেমন বাড়িঘর দলিত-মথিত হয়ে যায়, ডেঙ্গু হলে শরীর ও মনে ঠিক ওই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ঝড় ও সাইক্লোন শেষ হওয়ার পর যেমন করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু করতে কিছু সময় লাগে, তদ্রূপ ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার পরও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু করতে খানিকটা সময় নেওয়া উচিত।

ব্রেনের অ্যানালাইটিক্যাল ক্ষমতা হ্রাস পায়

ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার পর রোগী দুর্বল থাকে, অবসাদগ্রস্ত থাকে, মাথা হালকা থাকে, চলাফেরার সময় কিছু ভারসাম্যহীনতা থাকে, গভীর ও নিবিড়ভাবে কাজে মনোনিবেশ করা যায় না।

যাঁরা প্রফেশনাল কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাঁরাও জ্বর সেরে ওঠার পর গভীরভাবে কাজে মনোনিবেশ করতে পারেন না। যেমন—চিকিৎসকরা জটিল রোগী নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারেন না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে গভীরে যেতে পারেন না। অর্থাৎ ব্রেনের অ্যানালাইটিক্যাল ক্ষমতা হ্রাস পায়, তাই এই সময়ে ওই ধরনের কাজে হাত দেওয়া ঠিক নয়। বরং ওই ধরনের কাজ করতে গেলে পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে না।

এক ধরনের অবসাদ ও হতাশা সৃষ্টি হবে। কিন্তু সপ্তাহ দু-তিনেক পর রোগীর শারীরিক ও মানসিক কাজ করার ক্ষমতা আগের মতোই ফিরে আসবে। তাই ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার পর শিথিলতার সঙ্গে দু-তিন সপ্তাহ কাটাতে হবে।

করণীয়

যাঁরা শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে উপার্জন করেন, তাঁরাও দ্রুত ওই ধরনের কাজে যাবেন না। যেমন—রিকশাচালক সঙ্গে সঙ্গে রিকশা চালানো শুরু করবেন না। যিনি মাটি কাটেন, তিনিও সঙ্গে সঙ্গে মাটি কাটতে যাবেন না। যিনি বোঝা বহন করেন, তিনিও সঙ্গে সঙ্গে বোঝা বহন করতে যাবেন না। সপ্তাহ দুয়েক শিথিলতার সঙ্গে সময় কাটান, তারপর আস্তে আস্তে নিজ কাজে হাত দেন। এ সময় কিছু করণীয় হলো—

১। স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়া শুরু করুন

ডেঙ্গুর সময় রোগীরা সাধারণত তরল, নরম এবং সহজপাচ্য খাবারের ওপর নির্ভরশীল থাকে। জ্বরের সময় যে খাবারগুলো খেতে বারণ করা হয়েছে, সেগুলোকে এখনো না বলুন। আর যেগুলো খেতে বলা হয়েছে, সেগুলোকে এখনো হ্যাঁ বলুন। তরল, নরম ও সহজপাচ্য খাবার থেকে আস্তে আস্তে উঠে আসুন।

তরল খাবার আগের মতো বেশি না খেয়ে কিছুটা কমিয়ে ফেলুন। ফলমূল যেভাবে বেশি করে খেয়েছেন, সেভাবে না খেয়ে স্বাভাবিক সুস্থ মানুষ যেভাবে খায়, সেভাবে খেতে থাকুন। নরম খাবার, যেমন জাউভাত না খেয়ে এখন ভাত খান। তবে এ পর্যায়ে গুরুপাক খাবার, যেমন—রোস্ট, বিরিয়ানি ইত্যাদি না খেয়ে লঘুপাক বা কম মসলা দিয়ে সহজে হজম হয় এমন খাবার খান।

২। রাতে প্রয়োজন নিবিড় নিদ্রা

কারো আগে থেকেই রাত জাগার অভ্যাস থাকলে ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার পর এই অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। পারতপক্ষে রাত ১০টার পর আর জেগে থাকবেন না। শোয়ার ঘর ছিমছাম করে, বিছানা ছিমছাম করে, বাতি নিভিয়ে রাত ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ুন। মনে রাখবেন, দিনে কাজ করার মধ্যে, জেগে থাকার মধ্যে দেহের যে ক্ষতি হয়, রাতে ঘুমানোর পর সে ক্ষতি পুষিয়ে যায়। রাতের বেলায় ক্ষতিপূরণকারী কিছু হরমোন যেমন : ACTH, steroid, growth hormone ইত্যাদি শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়। দিনের বেলায় জেগে থাকার ফলে যে বিষাক্ত পদার্থ তৈরি হয়, রাতে ঘুমানোর ফলে ওই বিষাক্ত পদার্থ নিঃশেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ পরিপূর্ণ নিবিড় ঘুমের মাধ্যমে ব্রেন সতেজ হয়, মন সতেজ হয়, শরীরও সতেজ হয় এবং ক্লান্তি দূর হয়। 

৩। মানসিক চাপ নেবেন না

এই সময়ে কখনো মানসিক চাপ নেবেন না। কোনো কারণ থাকলেও মেজাজ খারাপ করবেন না। বরং মেজাজ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখুন, তথা মন সতেজ ও ফুরফুরে রাখবেন।

৪। দিনের বেলায় পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন

অন্য সময় দিনের বেলায় পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিলেও ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার পর দিনে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়ার অভ্যাস করুন। দুপুরে খাওয়ার পর ঘণ্টাখানেক ঘুমানোর চেষ্টা করুন। এ ছাড়া দিনের অন্যান্য সময় ঘণ্টাখানেক পর পর ৫-১০ মিনিট চোখ বন্ধ করে হাত-পা ছেড়ে শুয়ে থাকুন। অফিস-আদালতে থাকলে ৫-১০ মিনিট চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাটান।

৫। এই সময় ব্যায়াম নয়

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার আগে যদি জিমে যাওয়ার অভ্যাস থাকে, তাহলে ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার পর কিছুদিন জিম থেকে দূরে থাকুন। প্রয়োজন হলে এক বা দুই মাস অপেক্ষা করুন। নিয়মিত ব্যায়াম করার অভ্যাস থাকলেও এই সময় ব্যায়াম করবেন না।

৬। পর্যায়ক্রমে চলাফেরা শুরু করুন

প্রথমে বাড়িতে চলাফেরা করুন, তারপর বাড়ির আঙিনায় যান, এরপর উপাসনালয়, বাজার, অফিস-আদালতে যাওয়ার চেষ্টা করুন। অফিস-আদালতে হালকা রুটিন ওয়ার্ক করুন। এভাবে সপ্তাহ দু-তিনেক কাটান। তারপর যাঁর যে কাজ সে কাজ শুরু করুন।

আরও পড়ুন

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা

চুল পড়া রোধে প্রাকৃতিক উপায়

ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে ১০টি তথ্য জেনে নিন

থাইরয়েড কি, কি কারনে হয় , এর লক্ষন, প্রতিকারের উপায়

৭। প্রচুর পানি পান করুন

ডেঙ্গু থেকে সুস্থ হওয়ার পর দৈনিক ৩-৪ লিটার পানি পান করুন। প্রচুর পানি পান করলে শরীরে রক্তের প্রবাহ বাড়ে এবং খাবারের সঙ্গে থাকা পুষ্টি উপাদান শরীরে প্রবাহিত হয়। তাছাড়া স্যালাইনের মাধ্যমে শরীরে ইলেকট্রোলাইটের চাহিদাও পূরণ করুন। 

৮। ডাবের পানি পান করুন

ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর শরীর দুর্বল থাকেই। আর এই সময় শরীরে ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য থাকে কম। সেজন্য সপ্তাহে তিন দিন ডাবের পানি নিয়মিত পান করুন। দুর্বল ভাব দূর হবে। 

৯। খাদ্যাভ্যাসে বদল

ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত অবস্থায় খাবারের অভ্যাসে বদল আনা জরুরি। আক্রান্ত হওয়ার পরে যেহেতু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সময়ের যন্ত্রণা কম থাকে তাই প্লাটিলেট বাড়ে এমন খাবার খান। পেঁপে পাতার রস এক্ষেত্রে ভাল। আনার ও অন্যান্য অনেক ফল খাওয়া যায়। মধু ও তুলসী পাতা পানিতে ফুটিয়ে সে পানি খালি পেটে খেলেও উপকার পাবেন।

১০। টক জাতীয় ফল খান

ডেঙ্গু থেকে সুস্থ হওয়ার পর টক জাতীয় খাবার বেশি খান। লেবু, আমড়া, জলপাই বা অন্য টক ফল খেতে পারেন। 

১১। জ্বর হলে অবহেলা নয়

ডেঙ্গু থেকে সুস্থ হলেন। তারপর আবার জ্বর হলে সেলফ মেডিকেশন বা কোনোকিছুই নয়। ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন। ডেঙ্গুর বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি।

১২। আশপাশের জমা পানি দূর করুন

এডিস মশা ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করে। এই মশার কামড়ে আপনার ডেঙ্গু হয়। আর বাসাবাড়ির আশপাশে পানি জমলেই ডেঙ্গুর আবাসস্থল গড়ে ওঠে। প্রথমেই আপনার উচিত হবে ঘরে যেন মশা ঢুকতে না পারে সে ব্যবস্থা করা৷ ঘরের আশপাশে বদ্ধ পানি জমা অথবা ময়লা ঝেটে দূর করুন। এমনকি ঘরে মশারি ব্যবহার করুন। 

সব শেষে আবার বলি, ডেঙ্গু সেরে ওঠার পর সপ্তাহ দুয়েক, এমনকি মাসখানেক সাবধানে থাকবেন। কথায় বলে—সাবধানের মার নেই। তবে খুব বেশি সমস্যা মনে করলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।

1 thought on “ডেঙ্গু পরবর্তী রোগীর পরিচর্যা ও আমাদের করনীয় করনীয়”

Leave a Comment