সহজেই সারে ছোটদের থাইরয়েড

Spread the love

পৃথিবীতে অন্তত ১২ শতাংশ মানুষ থাইরয়েডজনিত সমস্যায় ভোগেন। থাইরয়েডের সমস্যা অত্যন্ত সাধারণ এবং পরিচিত একটি রোগ। বেশির ভাগ সময়ে মহিলারা বেশি আক্রান্ত হলেও মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা বহু মানুষের শরীরে দেখা দেয়। সহজ করে বলতে গেলে, থাইরয়েড গ্রন্থি যেই থাইরয়েড হরমোনের সৃষ্টি করে, তার মাত্রা প্রয়োজনের থেকে বেশি বা কম হওয়াতেই এই সমস্যাগুলি দেখা দেয়। থাইরয়েড হরমোন মূলত বিপাকের ক্ষেত্রে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশের গঠনের জন্য গুরুত্ত্বপূর্ণ। কিন্তু এই হরমোনের মাত্রা শরীরে অত্যধিক বেশি বা কম হয়ে গেলে তা বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করে।

থাইরয়েড হরমোন শরীরের থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত অতি প্রয়োজনীয় একটি উপাদান, যার অভাব হলে শিশু শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী হতে পারে। পরবর্তী সময়ে চিকিৎসা করেও আর লাভ হয় না।

মাতৃগর্ভে থাকতেই শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য এই হরমোন দরকার, তাই প্রত্যেক গর্ভবতী মায়ের থাইরয়েড সমস্যা আছে কি না, তা জানা এবং প্রয়োজনে চিকিৎসা করা আবশ্যক। কারণ, ‘কনজেনিটাল হাইপোথাইরয়েডিজম’ সময়মতো শনাক্ত হলে চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

ছোটদের থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা, রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা নিয়ে বুঝিয়ে দিলেন ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের শিশুরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. দিব্যেন্দু রায়চৌধুরী। তিনি জানাচ্ছেন, থাইরয়েডের সমস্যা দুই রকমের হয়। হাইপোথাইরয়েডিজম বা থাইরয়েড হরমোন কম ক্ষরণজনিত সমস্যা ও হাইপারথাইরয়েডিজম অর্থাৎ এই হরমোন বেশি ক্ষরণের সমস্যা। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি হাইপোথাইরয়েডিজমই বেশি দেখা যায়। 

প্রাইমারি হাইপোথাইরয়েডিজমের কারণ 

 ১। কোনও ‘অটোইমিউন’ (যেখানে অনাক্রম্যতা শক্তি শরীরকেই আক্রমণ করে) কারণে হতে পারে।

২। বাচ্চার থাইরয়েড গ্রন্থি ভালো করে তৈরি না হলে স্বাভাবিক ভাবেই থাইরয়েডের ক্ষরণ কম হয়।

৩। থাইরয়েডের সংক্রমণ বা কোনও অসুখের কারণে শল্যচিকিৎসা করে বাচ্চার থাইরয়েড গ্রন্থির কিছুটা বাদ দিলেও হাইপোথাইরয়েডিজম হয়।

৩। গর্ভাবস্থায় মা কিছু বিশেষ ধরনের ওষুধ খেলেও বাচ্চার হাইপোথাইরয়েডিজম হয়।

৪। বাচ্চা ‘লিথিয়াম’, ‘অ্যামিয়োডারোন’ জাতীয় ওষুধ খেলেও তার এই সমস্যা হতে পারে।

৫। এছাড়া কোনও কারণে রেডিয়েশন দেওয়া বা জোরে আঘাত লাগলেও সেকেন্ডারি হাইপোথাইরয়েডিজম হতে পারে।.

৬। দেহের ‘হরমোন রিসেপ্টর সিস্টেম’ ঠিক ভাবে কাজ না করলেও বাচ্চার শরীর থাইরয়েড হরমোনের কার্যকারিতার সুফল গ্রহণ করতে পারে না।

হাইপোথাইরয়েডিজ়মের রোগলক্ষণ কী কী

  •  বাচ্চার সার্বিক বিকাশে খামতি থাকে। একে বলে ক্রেটিনিজ়ম।
  • বাচ্চার জিহ্বা বড় হতে পারে, মুখটা ফোলা ফোলা লাগে।
  •  পেশিতে শৈথিল্য থাকে। পেটটা ফোলা লাগে। থাইরয়েডের কারণেও খুব ছোট বাচ্চার আম্বিলিক্যাল হার্নিয়া (নাড়ি ফুলে থাকা)হতে দেখা যায়। হাড়ের গঠনে সমস্যা হতে পারে।
  • ·ত্বক খসখসে হয়।
  •  কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা যায়।
  •  অল্পতেই বাচ্চার শীত করবে।
  •  কনজেনিটাল হাইপোথাইরয়েডিজ়মের ক্ষেত্রে (যেখানে জন্ম থেকেই থাইরয়েড গ্রন্থি ঠিক মতো কাজ না করার ফলে থাইরয়েড ক্ষরণ কম থাকে) মস্তিষ্কের বিকাশে প্রভাব পড়তে পারে। মানসিক গঠন ঠিক মতো হয় না, আই কিউ লেভেল কমের দিকে থাকতে পারে। এর ফলে বাড়বৃদ্ধি সময় মতো হয় না। ব্রহ্মতালু সময়মতো বন্ধ হয় না (অর্থাৎ জন্মের পর যেমন ছিল, স্ক্যাল্পের একটি গোলাকার অংশ সে রকমই দপদপ করতে থাকে।

থাইরয়েডের পরীক্ষা ও চিকিৎসা 

বিভিন্ন গাইডলাইন অনুযায়ী, জন্মের সঙ্গে সঙ্গে সব শিশুর কর্ড ব্লাড বা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে রক্তে টিএসএইচ পরীক্ষা করে স্ক্রিনিং করতে হবে। এ ছাড়া স্বল্প ওজন ও অতি অসুস্থ নবজাতকের ক্ষেত্রে সাত দিনের মাথায় বা কিছুটা সুস্থ হলে পুনরায় পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে।

তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ঝুঁকিতে থাকা নবজাতকের থাইরয়েড সমস্যা নির্ণয়ের জন্য তিন-চার দিনের সময় এফটিফোর ও টিএসএইচ পরীক্ষা করাই উত্তম। এ ছাড়া যেকোনো শিশুর মধ্যে থাইরয়েড সমস্যার কোনো উপসর্গ দেখা গেলে তাৎক্ষণিকভাবে পরীক্ষা করা বাঞ্ছনীয়।

কনজেনিটাল হাইপোথাইরয়েডিজম রোগ নির্ণীত হলে দেরি না করে দ্রুত লিভোথাইরক্সিন খাওয়াতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সারা জীবন ওষুধ চালিয়ে যেতে হয়। ওষুধের মাত্রা রোগীভেদে ভিন্ন, তবে প্রাথমিকভাবে ১ মাস বয়স পর্যন্ত প্রতি কেজি ওজনের জন্য ১০-১৫ মাইক্রোগ্রাম হিসেবে শুরু করা যেতে পারে।

তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজনে আরও পরীক্ষা করে সঠিক কারণ নির্ণয় করবেন এবং নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে পরীক্ষা করে ওষুধের মাত্রা ঠিক করবেন। মনে রাখতে হবে, যেকোনো ওষুধেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, তাই অবশ্যই নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে।

আরও পড়ুন

ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে ১০টি তথ্য জেনে নিন

চুল পড়া রোধে প্রাকৃতিক উপায়

স্বাস্থ্য ভালো রাখার কয়েকটি সহজ উপায়

স্কুলপড়ুয়া সন্তানের দিকেও লক্ষ রাখুন

জন্মের সময়ে থাইরয়েডের সমস্যা না থাকলেও পরে ওষুধ খাওয়া, সার্জারি বা কোনও কারণে এই অসুখ হতে পারে। একে ‘অ্যাকোয়ারড হাইপোথাইরয়েডিজ়ম’ বলা হয়। অনেক সময়ই দেখা যায় বয়ঃসন্ধির কোনও স্কুলপড়ুয়ার শারীরিক গঠন সমবয়সিদের থেকে একটু আলাদা। হয়তো, তার চোখমুখ ফোলা, চেহারাটা ভারী এবং গলার কাছে ফোলা ভাব আছে। এর জন্য বন্ধুদের সামনে সে গুটিয়ে থাকতে পারে। অভিভাবক বা স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা এমন ছেলেমেয়ের দিকে একটু বিশেষ নজর দিন। হতে পারে, তারও থাইরয়েডের সমস্যা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। ডা. রায়চৌধুরী জানাচ্ছেন, একটু বড় বয়সে কিন্তু রোগলক্ষণগুলি সূক্ষ্ম হয়। তিনি স্কুলপড়ুয়ার শরীরে থাইরয়েডের সমস্যার লক্ষণগুলি চিনিয়ে দিলেন। বললেন, মেয়েদের ক্ষেত্রে ওজন বেশির দিকে হয়, ঋতুচক্র অনিয়মিত থাকে, শীত করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগে। এদের গয়টারও হয়। অর্থাৎ, গলার সামনের দিকটা ফুলে যায়। এ ক্ষেত্রে থাইরয়েড কম সংশ্লেষ হলে গ্ল্যান্ডটা নিজেকে আরও বড় করে আরও হরমোন সংশ্লেষের চেষ্টা করে। এ সব ক্ষেত্রেও চিকিৎসার মাধ্যমে সমস্যা উধাও হবে। পরিপূর্ণ সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন লাভ করা সম্ভব হবে।

উপসংহার

মূলত, জেনেটিক কারণে শিশুদের মধ্যে থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা বংশানুক্রমিক। অনেক ক্ষেত্রে আবার বাচ্চাদের শরীরে আয়োডিনের অভাব থাকলেও থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দিতে পারে। আয়োডিন থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনে সাহায্য করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে কোনও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে থাইরয়েড হরমোন নিঃসরণ কমে যেতে পারে বা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এমন ঘটনা নবজাতকের মধ্যে দেখা না গেলেও, ছোট বাচ্চাদের মধ্যে ঘটে থাকে।