শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলার গুরুত্ব

শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলার গুরুত্ব

খেলাধুলা এমন একটি কার্যকলাপ যা বিনোদনের জন্য আবার কখনও জ্ঞান অর্জনের একটি হাতিয়ার হিসাবে বিবেচিত হয়। বিনোদনের জন্য খেলাধুলা একটি স্বতন্ত্র মাধ্যম যা অনন্য রূপ শুধুমাত্র উপভোগ বা পুরস্কারের জন্য করা হয়। কাজের চেয়ে খেলাধুলা সাধারণত একটু ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। খেলাধুলা মূলত বন্ধুত্ব রক্ষার, ঐতিহ্য এবং সৌন্দর্যবোধ জন্য আয়োজন করা হয়। তবে কিছু খেলা কাজ বা পেশার অংশ। উদাহরন স্বরূপ বলা যায়, পেশাদার ক্রীড়াবিদ যারা নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং অন্যদের বিনোদন দেয়। খেলাধুলা দুই প্রকার, একটি হল কাজের দ্বারা খেলা এবং অন্যটি মন দিয়ে খেলা।

ভূমিকা

মানুষ সবসময় তাদের জীবনের মান উন্নত করতে ক্লান্ত হয়ে যায়। কারণ মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে। প্রতিনিয়ত ছুটছেন আরও সাফল্যের পিছনে। খেলাধুলা মানুষের এই কর্মময় জীবনে একটু প্রশান্তি এনে দেয়। খেলাধুলা এই সংগ্রামরত জীবনের সাথে মানুষকে অন্তত কিছু সময়ের জন্য জীবন উপভোগ করতে শেখায়।

 

খেলাধুলার উদ্ভব ও বিকাশ

 খেলাধুলার উত্থান ঘটে সভ্যতার সূচনাকালের পরে এবং ধীরে ধীরে বিকশিত হয় এবং এখনও হচ্ছে। অনেকে বিশ্বাস করেন যে প্রথম খেলাটি শুরু হয়েছিল প্রাচীন মেসোপটেমিয়াতে, অর্থাৎ বর্তমান ইরাকে, খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ এর আগে। আর সেটা হল কুস্তি। একই সময়ে বক্সিং, অসিযুদ্ধ এবং দৌড়ের মতো খেলাধুলারও জন্ম হয়। ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, মিশরে শিকার একটি খেলা হিসাবে শিকারের প্রচলন ছিল। ।

খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দে প্রাচীন রোমে কুস্তি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। যাইহোক,৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন গ্রীসে অলিম্পিকের সূচনা হল খেলাধুলা ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলির মধ্যে একটি। অলিম্পিক এখনও বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া ইভেন্টের নাম। এখন বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ধরনের খেলা রয়েছে। ফুটবল, হকি, বাস্কেটবল, পোলো, স্কেটিং, সাঁতার, ক্রিকেট, রাগবি, হ্যান্ডবলসহ বিভিন্ন খেলার জন্ম হয়েছে বিভিন্ন দেশে।

খেলাধুলার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

১। ব্যক্তিত্ব অর্জনে খেলাধুলা

ব্যক্তিত্ব বিকাশে খেলাধুলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজিতে একটি প্রবাদে আছে- All work and no play make Jack a dull boy. আসলে মনের সতেজতা ও প্রাণশক্তি বৃদ্ধিতে খেলাধুলার ভূমিকা যথেষ্ট। খেলাধুলায় সুস্থ প্রতিযোগিতা আছে। অনুশীলনের মাধ্যমে মনের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও শক্তি তৈরি করে। একটি কৌতুকপূর্ণ মনোভাব অর্জন করে, জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সহজ হয়ে ওঠে।

মানসিক চাপ দূর করার একটি দুর্দান্ত উপায় হল খেলাধুলা । এছাড়া বিভিন্ন চিন্তার খেলা যেমন- দাবা, তাস ইত্যাদি মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটায়। মানুষের আত্মশক্তি অর্জনের জন্য খেলাধুলার ভূমিকা অসামান্য। জনি ওয়াইজমুলারই, যিনি শৈশবে বিভিন্ন রোগে মরতে বসেছিলেন, সেই তিনিই অলিম্পিক সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিলেন। চেকোশ্লোভাকিয়ার এমিল জটোপেক, ‘হিউম্যান লোকোমোটিভ’ নামে পরিচিত যিনি ১৯৬০ সালের অলিম্পিক রেসে তিনটি রেস জিতেছিলেন, যিনি কিনা ছোটবেলায় খুঁড়িয়ে চলতেন।

২। শিক্ষায় খেলাধুলা

শিক্ষায় খেলাধুলার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খেলাধুলা শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে শিক্ষায় খেলাধুলার গুরুত্ব বাড়ছে। বর্তমানে, বাংলাদেশের অনেক স্কুল ও কলেজ খেলাধুলার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনা করেছে। এছাড়াও, বাংলাদেশে অনেক সরকারি ও বেসরকারি খেলাধুলার প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলো শিক্ষার্থীদের খেলাধুলায় উৎসাহিত করে।

৩। মানব-মৈত্রী গঠনে খেলাধুলা

খেলাধুলা মানব-মৈত্রী গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খেলাধুলার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মানুষ একত্রিত হয়ে একসাথে খেলাধুলা করে। এই খেলাধুলার মাধ্যমে তারা একে অপরের সাথে পরিচিত হয় এবং তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। খেলাধুলা বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ও বোঝাপড়া বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। খেলাধুলার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মানুষ একসাথে খেলাধুলা করে এবং একে অপরের সাথে কথা বলে। এই যোগাযোগ ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে তারা একে অপরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে।

আরও পড়ুন

মা হিসেবে নারীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য

ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির ঔষধ

ডিপ্রেশন হলে কি কি সমস্যা হয়

৪। স্বাস্থ্যোন্নয়ন ও রোগ প্রতিরোধে খেলাধুলা

স্বাস্থ্য রক্ষায় খেলাধুলার বিকল্প নেই। শরীরের কোষের পুষ্টি, সহজ ও স্বাভাবিক রক্ত ​​সঞ্চালন এবং পরিপাকতন্ত্রকে সচল রাখার উদ্দেশ্যে প্রত্যেকেরই প্রতিদিন কোনো না কোনো শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়ামে অংশ নেওয়া উচিত। খেলাধুলা শুধুমাত্র স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যই নয়, বিভিন্ন রোগ থেকে স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যও প্রয়োজনীয়। হার্ট ও ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে খেলাধুলা। খেলাধুলা মানুষের মনে উদ্বেগ কমায়, সহনশীলতা বাড়ায় এবং শারীরিক পরিশ্রমের ক্ষমতা বাড়ায়। সাঁতারের মতো খেলাধুলা মানুষের ফুসফুসের ক্ষমতা বাড়ায়। মেদ ঝরিয়ে সুন্দর ও ফিট শরীর গঠনে খেলাধুলার বিকল্প নেই।

৫। চরিত্র গঠনে খেলাধুলা

খেলাধুলাও একজন ব্যক্তির চরিত্র গঠনে বিশাল ভূমিকা পালন করে। খেলাধুলার মাধ্যমে মানুষের চরিত্রে শক্তি আসে। খেলাধুলা করার জন্য ধৈর্য এবং সংযম উভয়ই প্রয়োজন। ফলস্বরূপ, যারা খেলাধুলা করে তাদের ব্যক্তিগত জীবন এবং চরিত্রে এই দুটি অঙ্কিত হয়। খেলাধুলায় জয়ের আনন্দ এবং পরাজয়ে দুঃখ থাকে এবং ফলাফল যাই হোক মানুষ মেনে নিতে বাধ্য হয়। ফলে যেকোনো বিষয়ে জয়-পরাজয় সহজে মেনে নেওয়ার মানসিকতা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনেও তৈরি হয়। যে ব্যক্তি খেলাধুলার সময় সৎ, অন্যকে প্রতারণা করা থেকে বিরত থাকে। ব্যক্তি জীবনেও সেই ব্যক্তি সৎ। খেলাধুলার মাধ্যমে ব্যক্তির চরিত্রে আত্মবিশ্বাস, প্রত্যয়, অধ্যবসায়ের মতো মানসিক গুণাবলী যুক্ত হয়।

৬। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়

পুরো বিশ্বকে একত্রিত করে খেলার মাঠ । একটি দেশের শুধু দল খেলাধুলা করে না বরং তার নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। যে দেশগুলো গেমসের আয়োজক তারা তাদের সংস্কৃতি বিশ্বের কাছে তুলে ধরে। ফলে তার দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অন্যান্য দেশের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। কিছু সাংস্কৃতিক বিষয় মানুষের মধ্যে অনুকরণীয় এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটে।

৭। শারীরিক সুস্থতায় খেলাধুলা

খেলাধুলা শারীরিক সুস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খেলাধুলার মাধ্যমে ব্যক্তি তার শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে। খেলাধুলা ব্যক্তির শক্তি, গতি, সহনশীলতা, নমনীয়তা, সমন্বয়তা ও ভারসাম্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এছাড়াও, খেলাধুলা ব্যক্তির স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এবং তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

৮। মানসিক বিকাশে খেলাধুলা

 

খেলাধুলা ব্যক্তির মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খেলাধুলার মাধ্যমে ব্যক্তি তার মানসিক দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারে। খেলাধুলা ব্যক্তির মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি, চিন্তাভাবনা, সমস্যা সমাধান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এছাড়াও, খেলাধুলা ব্যক্তির মানসিক চাপ মোকাবেলা করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং তার আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ বৃদ্ধি করে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আরও দেখা যায় যে, যে সকল শিশুরা খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত হয়, তাদের মানসিক বিকাশ অন্যান্য শিশুদের তুলনায় বেশি ব্যাহত হয়।

৯। শৃঙ্খলাবোধ তৈরিতে খেলাধুলা

শৃঙ্খলা একজন ব্যক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ যেমন একটি সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য শৃঙ্খলা অনুসরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিশৃঙ্খল সমাজ ও রাষ্ট্র চরম নৈরাজ্যের জায়গা। খেলাধুলা মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে এবং তাদের একটি সুশৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তোলে। প্রতিটি খেলার কিছু নিয়ম থাকে। আপনি যদি খেলাধুলা করতে চান তবে আপনাকে সেই নিয়মগুলি মেনে চলতে হবে। দলকে অন্যদের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। দলের প্রতি অনুগত থাকুন। নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে।

আপনি যদি খেলাধুলা করতে চান তবে আপনাকে সেসব নিয়মগুলি মেনে চলতে হবে। দলকে অন্যদের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। দলের প্রতি অনুগত থাকুন। নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে। দলনেতা বা কোচকে মানতে হয়। আর এসব করতে গিয়ে মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধের জন্ম হয়। শৃঙ্খলা বোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত, মানুষ একটি ঝরঝরে, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন, আত্ম-উন্নতি সাধন করে।

১০। সম্প্রীতির বন্ধন তৈরিতে খেলাধুলা

মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি হয় খেলাধুলার মাধ্যমে । খেলাধুলা করার সময় একজন আরেকজনের সাথে খেলতে হয়। আপনাকে অন্যের সাহায্য নিতে হবে, অন্যের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে হবে। দলের একজন খেলোয়াড় অন্যজনের ওপর নির্ভরশীল। খেলার মাধ্যমে তৈরি এই পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরযোগ্যতা মানুষের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করে। সে সম্পর্ক সহযোগিতা, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির অন্যতম। খেলাধুলা শুধু খেলোয়াড়দের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি করে না। বরং খেলাটি দর্শক ও সমর্থকদের মধ্যেও এক ধরনের সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য সৃষ্টি করে।

অতিরিক্ত খেলাধুলার কুফল

যদিও খেলাধুলার অনেক সুবিধা রয়েছে, তবে এর কিছু খারাপ দিকও রয়েছে। অতিরিক্ত খেলাধুলা মানব স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হতে পারে। ফুটবল, কাবাডি, রাগবি, রেসলিং, বক্সিং ইত্যাদিতে মারাত্মক ইনজুরি আছে। অতিরিক্ত খেলাধুলা-আসক্তি কখনো কখনো জীবনের স্বাভাবিক ও মসৃণ বিকাশের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া দল এবং তাদের অন্ধ সমর্থকরা বিজয়ী দল বা তাদের সমর্থকদের সাথে মারামারি শুরু করে। খেলাধুলায় এমন ধর্মান্ধতা কখনোই কাম্য হতে পারে না।

শেষকথা

অতীতে, মানুষ তাদের নিজস্ব আনন্দ খুঁজে পেতে খেলার উদ্ভাবন করেছিল। খেলাধুলা যেমন নির্মল আনন্দ দেয় তেমনি জীবনকে করে তোলে আনন্দময়। শুধু তাই নয়, খেলাধুলা একজন ব্যক্তির নাম, সাফল্য, খ্যাতি, অর্থ বয়ে আনে। মানুষকে আবদ্ধ করে বন্ধুত্বপূর্ণ ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে । পরস্পরের মধ্যে তিক্ততা দূর করে মনে আনে প্রশান্তি। খেলার মাধ্যমে খেলোয়াড়রা তাদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করে বিশ্বের কাছে। দেশের জন্য খ্যাতি ও সম্মান বয়ে আনে। তাই জাতীয় জীবনে খেলাধুলার গুরত্ব অপরিসীম।

One thought on “শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলার গুরুত্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *