প্রথম চাকরির উত্তেজনা: প্রস্তুতি ও সফলতার টিপস

Spread the love

অনেকগুলো বছর লেখাপড়া শেষে মানুষ কর্মজীবনে প্রবেশ করে। বহু দিন ধরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বা অল্প সময়ের সংগ্রামে, যেভাবেই হোক না কেন প্রথম চাকরি একজন মানুষের জীবনে খুব বিশেষ অনুভূতি এনে দেয়। এতদিন ছাত্র জীবন কাটিয়েছে, তারপর নানান প্রস্তুতি, বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারভিউ, অবশেষে সোনার হরিণ নামক এই চাকরি হাতের মুঠোয় এসেছে। এবার তার সামনে এক নতুন জগৎ। অচেনা, অজানা। অন্যরকম এক উত্তেজনা।

লেখাপড়া এবং চাকরি পাওয়ার জন্য তাকে যেমন নানান ধরনের প্রস্তুতি নিতে হয়েছে, তেমনি প্রথম চাকরির জন্যেও কিন্তু প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। অতি জনপ্রিয় একটি প্রবাদ হলো “হাজার মাইলের যাত্রা শুরু হয় একটি মাত্র পদক্ষেপ দিয়ে”। তার সামনে এখন সত্যিই হাজার মাইলের একটি যাত্রা। সঠিক এবং সুন্দর পদক্ষেপ দিয়ে তার এই যাত্রাটি শুরু করতে হবে। যা তাকে প্রথম পর্যায়ে সফলতার দিকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।

প্রথম চাকরির জন্য নানাবিধ প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। এখানে তার কয়েকটি আলোচিত হয়েছে।

মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়া

ছাত্র জীবন বা তার পরবর্তী সময়ের তুলনায় কর্মজীবনের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে নিজ ইচ্ছামত সময় কাটানোর কোন অবকাশ নেই। প্রতিটি কাজ চলবে একেবারে ঘড়ি ধরে। তাই অহেতুক আড্ডা দেওয়া, ফোনে আলাপ করা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় কাটানো, এসব অভ্যাস অনেকাংশেই পরিত্যাগ করতে হবে। সকাল থেকে বিকাল বা রাত পর্যন্ত কর্মস্থলে থাকার সময় সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে কাজে,অন্য কোন স্থানে নয়। তাই ধীরে ধীরে পূর্বের সমস্ত বদ অভ্যাস কাটিয়ে ওঠার জন্য সচেষ্ট হতে হবে, যেন কর্মস্থলে সব কাজ সুসম্পন্নভাবে করা সম্ভব হয়।

শারীরিক প্রস্তুতি

প্রথম চাকরিতে যোগদান করার জন্য শারীরিক প্রস্তুতিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিকভাবে আগে থেকেই তৈরি হতে হবে, তা না হলে হঠাৎ করে ঘড়ি ধরে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করতে গেলে শরীরের উপর একটা বিরূপ  প্রভাব পড়তে পারে। এখন আর মধ্য রাত পর্যন্ত জেগে থাকা যাবে না। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে সকালে উঠতে হবে। প্রয়োজনে হালকা ব্যায়াম করতে হবে। এটা খুবই জরুরী। কেননা এখন হয়তো অফিসে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে হবে, কখনো বা দাঁড়িয়ে কাজ করতে হবে, আবার বাইরে ছুটাছুটি করতে হতেও পারে। তাই শারীরিকভাবে ফিট না থাকলে সমস্যা হওয়াটাই স্বাভাবিক।

পরিচ্ছন্নতা

মানুষ স্বভাবতই একজন পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিকে পছন্দ করে। তাই নিজেকে সেভাবে উপস্থাপিত করতে হবে। নিজের পুরো শরীরের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। সুন্দর ভাবে চুল কাটতে হবে। যা হবে কর্মস্থলের জন্য মানানসই। হাত পায়ের নখ কেটে ফেলতে হবে। কেননা নখ খুবই দৃষ্টিকটু। প্রতিদিন দাত ব্রাশ করতে হবে, যেন কোনোক্রমেই মুখ থেকে কোন দুর্গন্ধ না আসে। প্রয়োজন হলে মাউথ ফ্রেশনার ব্যবহার করতে হবে। পুরো শরীর পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, যেন ঘামজনিত কারণে অন্যের অস্বস্তির কারণ না হয়।

পোশাক নিয়ে প্রস্তুতি

বাংলাতে একটা প্রবাদ আছে ‘পহেলা দর্শনধারী তারপরে গুণবিচারি’। পোশাকের সাথে ক্ষেত্রে এই কথাটি অনেকটাই প্রযোজ্য। সুন্দর ড্রেসআপ একটা মানুষের রুচিকে তুলে ধরে। অফিসে যদি ড্রেস কোড থাকে তাহলে তো সেটাই পরতে হবে। আর ড্রেস কোড না থাকলে অত্যন্ত মার্জিত পোশাক পরতে হবে। ছেলে বা মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই অফিসে সব সময় হালকা রঙের পোশাক পছন্দ করা উচিত। পোশাক হবে পরিচ্ছন্ন এবং ইস্ত্রি করা। মোটকথা পোশাক যেন রুচিশীলতার পরিচায়ক হয় এ ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।

অফিসের সবার সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন

যেকোন অফিসে বিভিন্ন ধরনের মানুষের উপস্থিতি থাকে। একজন গেট কিপার হতে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সবার সাথে সু-সম্পর্ক স্থাপন খুবই জরুরী। নিম্ন পদস্থ কর্মচারীদের অবজ্ঞা করা উচিত নয়। তারাও মানুষ এবং সম্মান পাওয়ার যোগ্য। ছোট-বড় সবার সাথে সালাম বিনিময় করা এবং কুশল জিজ্ঞাসা করা সু-সম্পর্ক স্থাপন করার একটা কার্যকরী পদ্ধতি। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য রাখা দরকার, নিজের সম্পর্কে অহেতুক বানিয়ে বলা বা নিজের দুর্বল বিষয়গুলো অন্যকে বলা উচিত নয়। অফিসে কাজের মাধ্যমে নিজের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। অনেক সময় অপ্রীতিকর কিছু প্রশ্ন অপর পক্ষ থেকে আসতে পারে। মুচকি হেসে সেগুলো এড়িয়ে যাওয়া বা সাবধানে উত্তর দেওয়া উচিত। কোনক্রমেই কারো সাথে কোন তর্কে যুক্ত হওয়া উচিত নয়। এছাড়া হেয় করে কথা বলা ঠিক নয়, সে যেই হোক না কেন। নিজের কাজের পাশাপাশি অন্যকে সাহায্য করাও খুব ভাল একটি গুন, যা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলে। অফিসের সবার সাথে সুসম্পর্ক যেমন কর্মক্ষেত্রে উপকারি হবে, তেমনি ব্যাক্তিগত জীবনে বিপদের সময় অনেকে এগিয়ে আসবে।

নতুন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অবহিত হওয়া

ইন্টারভিউ এর আগে নতুন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সবাই প্রাথমিকভাবে জেনে নেয়। তবে কাজে যোগদান কনফার্ম হওয়ার পরে প্রতিষ্ঠান এবং কর্মকর্তাদের ব্যাপারে আরও বেশি বিস্তারিত জানা প্রয়োজন। এজন্য ফেইসবুক, টুইটার, লিংকড ইন সহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান এবং কর্মকর্তাদের সম্পর্কে জানতে সার্চ করতে হবে। এ বিষয়ে জ্ঞান লাভ করলে তাদের পেশাগত জীবন ছাড়াও ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। সেসব তথ্য পরবর্তীতে কাজের জায়গায় অনেক ফলপ্রসূ হয়। প্রতিষ্ঠানের অতীত এবং বর্তমান ইতিহাস, পণ্য, প্রকল্প ইত্যাদি সম্পর্কে জানলে নিজের কর্মপন্থাও সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয়।

অন্য প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানতে হবে

নিজের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তো জানতেই হবে, এছাড়া একই ধরনের অন্য প্রতিষ্ঠান সম্পর্কেও জানাটা খুবই জরুরী। বর্তমান যুগ মার্কেটিং এবং প্রতিযোগিতার যুগ। তাই অন্য প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানা থাকলে যেমন তাদের ভালোটা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে নিজেদের কর্মপন্থা ঠিক করা যায়, তেমনি তাদের দুর্বলতা বুঝে অনেক কৌশল অবলম্বন করা যায়। এখনকার দিনে চোখ কান খোলা রেখে, চারিদিক সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে নিজেদের কাজের পথ ঠিক করলে সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

নিজেকে আত্মবিশ্বাসী রুপে উপস্থাপন করা

একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষকে যেমন সবাই পছন্দ করে, তেমনি কোন কাজের ক্ষেত্রে তাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তাই সবসময় নিজেকে আত্মবিশ্বাসী রূপে উপস্থাপন করতে হবে। কথা বলতে হবে স্পষ্টভাবে এবং দৃঢ়তার সাথে। কোন কাজে ভয় পেলে চলবে না। ভুল ত্রুটি হতেই পারে,  কর্মকর্তা বা সহকর্মীদের সাথে পরামর্শ করে সেগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে। কাজের ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রকাশ করতে হবে। কাজে যাদের প্যাশন আছে, তারা সবার নজর বেশি কাড়ে। নিজের কাজে কর্মে আশাবাদ ও আত্মবিশ্বাস ব্যক্ত করতে হবে, সবার মধ্যে এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে যে এই প্রতিষ্ঠানের কাজ সে উপভোগ করছে।

ইংরেজিতে দক্ষতা

ইংরেজিতে দক্ষতা কোন অপশনাল বিষয় নয়, অফিসে যদি কেউ ইংরেজি বলা, লেখা বা পড়াতে দক্ষতা দেখাতে পারে, তাহলে সে নিঃসন্দেহে থেকে অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকবে। তাই এব্যাপারে চাকরিতে যোগদানের পূর্বেই প্রস্তুতি নিতে হবে এবং যোগদানের পরে প্রয়োজনমতো বিভিন্ন স্থানে নিজের দক্ষতা উপস্থাপন করতে হবে।

অন্যান্য প্রস্তুতি 

বাড়ি থেকে অফিসে যাওয়ার পথটা ভালোমতো চেনা দরকার। যেন কোনক্রমে অফিসে পৌঁছাতে দেরি না হয়।

অফিসে যোগদানের পরে কোন কাগজপত্রের দরকার আছে কিনা সেটা আগে জেনে নিতে হবে। তারপরে  সব গুছিয়ে রেখে প্রথম দিনই জমা দিতে হবে।

দুপুরের খাবার বাসা থেকে নিলে ভালো, তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে কোথায় খাওয়া যায় সে ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া। অল্প হলেও দুপুরের খাওয়া জরুরী, কেননা অভুক্ত থাকলে কাজে কর্মে অলসতা আসতে পারে কিংবা নিজেকে দুর্বল লাগতে পারে, যার প্রভাব কাজে পড়বে।

নামাজ পড়ার অভ্যাস থাকলে নামাজের জায়গা সম্পর্কে আগে থেকে জেনে রাখতে হবে। অফিসে ব্যবস্থা না থাকলে প্রয়োজন হলে কয়েক জন মিলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলা যায়।

অফিসের ভিতরে কোন রকম বিধি নিষেধ বা বিশেষ করে নিয়ম কানুন আছে কিনা তা আগে থেকেই জেনে নিতে হবে। সেই অনুযায়ী নিজের কাজকর্ম করতে হবে।

 চাকরিতে সফলতার কিছু টিপস

  • একজন আশাবাদী, আত্মবিশ্বাসী এবং দৃঢ় চরিত্রের মানুষ যেমন যেকোনো কাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রস্তুত থাকে, তেমনি উপরের দিকে যাওয়ার পথও তার জন্য প্রশস্থ হয়।
  • সর্বক্ষেত্রে পরিপাটি এবং পরিচ্ছন্ন হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করা।
  • নেটওয়ার্ক বাড়াতে হবে। ব্যক্তিগত জীবনে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন মানুষের সাথে নেটওয়ার্ক থাকলে কর্মক্ষেত্রে অনেক সুবিধা হয়।
  • কর্মস্থলে সব ধরনের কাজ শেখা। এটা একজনকে কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকে।
  • নিজের একটা লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। সেই লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে ধারাবাহিকভাবে কাজ করতে হবে।
  • কর্মকর্তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। সঠিকভাবে প্রতিটি কাজের সম্পন্ন করতে পারলেই এটা সম্ভব।
  • সব সময় সঠিকভাবে কাজ করা সম্ভব হয় না। এসময় অন্যদের পরামর্শ নেওয়া যায়।
  • নেতিবাচক কথা এবং চিন্তাধারা বাদ দিয়ে ইতিবাচক ভাবে পথ চললে নিজে সাফল্য পাওয়া যায় এবং অন্যদের প্রভাবিত করা যায়।

চাকরিতে যোগদানের পর একজন মানুষ জীবনে বেশিরভাগ সময় এখানেই কাটিয়ে দেয়। তাই প্রথম থেকেই সচেতন ভাবে সঠিক পথে কাজ করে যেমন তার অবস্থান দৃঢ় করতে পারে, তেমনি ধীরে ধীরে  পদোন্নতি পাওয়া সম্ভব হয়। সেজন্য চাকরি পাওয়ার পরেই প্রতিটি বিষয়ে সুন্দরভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে এবং সফলতার পথে এগিয়ে যেতে হবে।

Leave a Comment

You cannot copy content of this page