“পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটার: আমাদের মস্তিষ্কের অবাক করা রহস্য”

Spread the love

আমাদের শরীরের সবচেয়ে বিস্ময়কর অঙ্গ হলো মস্তিষ্ক। ছোট্ট এই অঙ্গটি প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ কাজ করে, অথচ আমরা তা বুঝতেও পারি না। কেউ কেউ একে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটার বলেন, কারণ এটি একই সময়ে দেখা, শোনা, অনুভব করা, শেখা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কম্পিউটার যেখানে প্রোগ্রাম ছাড়া কিছুই করতে পারে না, সেখানে মস্তিষ্ক নিজে থেকে নতুন কিছু শিখে নিতে পারে। এই নিবন্ধে আমরা জানব কেন মস্তিষ্ককে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটার বলা হয়, এটি কীভাবে কাজ করে, এর ক্ষমতা কতটা অবিশ্বাস্য এবং ভবিষ্যতে মস্তিষ্ক ও প্রযুক্তি কীভাবে একসঙ্গে কাজ করতে পারে।

১। মস্তিষ্ক কেন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটার বলা হয়?

আমাদের শরীরের সবচেয়ে আশ্চর্য জিনিসগুলোর মধ্যে মস্তিষ্ক অন্যতম। একে অনেকেই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটার বলেন। কিন্তু কেন এমন বলা হয়? ভেবে দেখুন—একটা কম্পিউটার যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তার মধ্যে যা প্রোগ্রাম করা হয় শুধু সেটাই করতে পারে। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক? এটা প্রতিদিন নতুন কিছু শেখে, মনে রাখে, ভুলে যায়, আবার নতুন আইডিয়া তৈরি করে।

একটা ছোট উদাহরণ দিই—আপনি যখন ছোট ছিলেন, হাঁটতে বা কথা বলতে জানতেন না। ধীরে ধীরে শিখলেন। এই শেখার প্রক্রিয়াটি কোনো কম্পিউটারকে শেখানো যায় না এভাবে। মস্তিষ্ক নিজেই তার অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারে। এটাই একে শক্তিশালী করে তোলে।

মস্তিষ্কের আরেকটি বিশেষ ক্ষমতা হলো দ্রুত কাজ করা। বিজ্ঞানীরা বলেন, মস্তিষ্ক প্রতি সেকেন্ডে প্রায় কোটি কোটি সিগন্যাল প্রক্রিয়াজাত করতে পারে। অর্থাৎ আপনি যখন চোখ বন্ধ করেন, তখনও মস্তিষ্ক চোখের ছবি মনে রাখতে পারে, শব্দ শুনতে পারে, গন্ধ বুঝতে পারে—সব একসঙ্গে।

এছাড়া মস্তিষ্ক শুধু তথ্য মনে রাখে না, অনুভূতিও তৈরি করে। যেমন, আপনি প্রিয় গান শুনলে খুশি বোধ করেন বা ভয়ের সিনেমা দেখলে ভয় পান। কম্পিউটার কি এভাবে অনুভূতি বুঝতে পারে? একদম না। এ কারণেই বিজ্ঞানীরা একে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটার হিসেবে আখ্যা দেন। 

২। মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে – ভিতরের রহস্য

মস্তিষ্কের ভেতরে কীভাবে কাজ হয় জানেন? আমাদের মস্তিষ্ক আসলে কোটি কোটি স্নায়ুকোষ বা নিউরনের মাধ্যমে কাজ করে। এই নিউরনগুলো হলো একধরনের বৈদ্যুতিক তারের মতো, যেগুলো একে অপরের সাথে বার্তা আদান-প্রদান করে। যখন আমরা কিছু দেখি, শুনি বা ভাবি, তখন মস্তিষ্কের ভেতরে বৈদ্যুতিক সংকেত দ্রুত এক নিউরন থেকে আরেক নিউরনে ছুটে যায়।

ধরুন আপনি একটি ফুল দেখলেন। চোখ সেই ফুলের ছবি মস্তিষ্কে পাঠায়। তারপর মস্তিষ্ক বলে দেয়—”ওহ, এটা তো গোলাপ!” আবার আপনি যদি সেই ফুলের গন্ধ পান করেন, নাক সেই গন্ধের তথ্যও মস্তিষ্কে পাঠায়। মুহূর্তের মধ্যে মস্তিষ্ক সব তথ্য মিলিয়ে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে—ফুলটি পছন্দ হলো কি না।

মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয় হলো এটি একসাথে অনেক কাজ করতে পারে। আপনি যখন স্কুলের হোমওয়ার্ক করছেন, তখন একদিকে চোখ বই পড়ছে, হাত লিখছে, আর মস্তিষ্ক তথ্য মনে রাখছে। একই সময়ে আপনার কান হয়তো বাইরে পাখির ডাক শুনছে। এত কাজ একসাথে করার ক্ষমতা কোনো কম্পিউটারের নেই।

এছাড়াও মস্তিষ্ক আমাদের আবেগ, স্বপ্ন ও সৃজনশীলতাও নিয়ন্ত্রণ করে। নতুন গল্প বানানো, ছবি আঁকা বা গান লেখা—এসবই মস্তিষ্কের জাদু। বিজ্ঞানীরা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি, কীভাবে এত ছোট একটি অঙ্গ আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নিয়ন্ত্রণ করে।

 ৩। মস্তিষ্কের ক্ষমতা কতটা অবিশ্বাস্য?

মস্তিষ্কের ক্ষমতা সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু জানলেও, এখনও বেশিরভাগ রহস্য অজানা। বিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের মস্তিষ্কের ওজন গড়ে মাত্র দেড় কেজির মতো, কিন্তু এর ক্ষমতা পৃথিবীর যেকোনো কম্পিউটারের চেয়ে বহুগুণ বেশি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, মস্তিষ্ক দিনে প্রায় ২০ ওয়াট শক্তি ব্যবহার করে—যা একটি ছোট বাল্ব জ্বালানোর সমান। কিন্তু এই সামান্য শক্তিতেই মস্তিষ্ক কোটি কোটি কাজ করে ফেলে!

আপনি কি জানেন, মস্তিষ্ক এক সেকেন্ডে প্রায় ১ কোটির বেশি তথ্য প্রক্রিয়াজাত করতে পারে? যখন আপনি একটি ফুটবল খেলছেন, তখন মস্তিষ্ক মুহূর্তের মধ্যে বলের গতি, দিক, নিজের অবস্থান—সবকিছু হিসাব করে আপনাকে বল মারতে সাহায্য করে। এত দ্রুত কাজ কোনো মেশিন করতে পারে না।

আরেকটি মজার তথ্য হলো—আমাদের মস্তিষ্কের নিউরনের সংখ্যা প্রায় ৮৬ বিলিয়ন। প্রতিটি নিউরন হাজারো সংযোগ তৈরি করতে পারে। যদি সব সংযোগকে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়, তবে তা পৃথিবী থেকে চাঁদ পর্যন্ত কয়েকবার যাওয়া-আসার মতো লম্বা হবে!

সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো, মস্তিষ্ক শিখতে কখনও থামে না। ছোটবেলা থেকে বয়স বাড়া পর্যন্ত মস্তিষ্ক প্রতিদিন নতুন অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে। এজন্যই নতুন ভাষা শেখা, নতুন দক্ষতা অর্জন করা বা সৃজনশীল কিছু তৈরি করা সম্ভব হয়।

 ৪। মস্তিষ্ককে কীভাবে শক্তিশালী ও সুস্থ রাখা যায়?

মস্তিষ্ক শক্তিশালী হলেও এটি যত্ন না নিলে দুর্বল হয়ে যেতে পারে। যেমন শরীরকে সুস্থ রাখতে খাবার ও ব্যায়াম দরকার, তেমনি মস্তিষ্কেরও কিছু বিশেষ যত্ন প্রয়োজন। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে সঠিক অভ্যাস মস্তিষ্কের ক্ষমতা বাড়ায় এবং ভুল অভ্যাস এটিকে ধীরে ধীরে ক্ষতি করে।

প্রথমেই ঘুমের কথা বলি। পর্যাপ্ত ঘুম না পেলে মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। আমরা যখন ঘুমাই, তখন মস্তিষ্ক সারাদিনের শেখা জিনিসগুলো সাজিয়ে রাখে এবং শরীরকে পুনরুজ্জীবিত করে। তাই প্রতিদিন অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো জরুরি।

সুষম খাবারও খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাদাম, মাছ, ফল, শাকসবজি—এগুলো মস্তিষ্কের জন্য উপকারী। এগুলোর মধ্যে থাকা ভিটামিন ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড স্মৃতিশক্তি বাড়ায় ও মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে।

অন্যদিকে ব্যায়ামও মস্তিষ্কের শক্তি বাড়ায়। শরীরচর্চা করলে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয়, আর তাতে মস্তিষ্কে বেশি অক্সিজেন পৌঁছায়। এতে চিন্তা করার ক্ষমতা ও শেখার গতি বাড়ে।

সবশেষে মানসিক সুস্থতা রক্ষা করাও জরুরি। হাসি, ইতিবাচক চিন্তা, বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো—এসব মস্তিষ্ককে প্রশান্ত রাখে। দুশ্চিন্তা ও স্ট্রেস কমানো গেলে মস্তিষ্ক আরও ভালোভাবে কাজ করে।

 

ধাপ ৫: ভবিষ্যতে মস্তিষ্ক ও প্রযুক্তির সম্পর্ক

আজ আমরা কম্পিউটার ও মোবাইল ব্যবহার করে অসংখ্য কাজ করি। কিন্তু ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্ক ও প্রযুক্তিকে একসঙ্গে কাজ করানোর চেষ্টা করছেন। একে বলে ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (Brain-Computer Interface বা BCI)। এর মাধ্যমে মানুষ সরাসরি মস্তিষ্কের চিন্তাকে কম্পিউটারে পাঠাতে পারবে।

ভাবুন তো—আপনি শুধু চিন্তা করলেন আর কম্পিউটার আপনার লেখা লিখে ফেলল! আবার কোনো মানুষ যদি হাত-পা না নাড়তে পারে, সে শুধু মস্তিষ্কের মাধ্যমে রোবটকে নিয়ন্ত্রণ করে কাজ করাতে পারবে। অনেক বিজ্ঞানী ইতিমধ্যেই এ নিয়ে গবেষণা করছেন, এমনকি কিছু পরীক্ষায় আংশিক সফলতাও পেয়েছেন।

মস্তিষ্কের আরেকটি ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা হলো স্মৃতি সংরক্ষণ প্রযুক্তি। একদিন হয়তো আমরা আমাদের স্মৃতিগুলো কম্পিউটারে সংরক্ষণ করতে পারব এবং পরে আবার মনে ফিরিয়ে আনতে পারব। এটা শুনতে সিনেমার মতো লাগলেও বিজ্ঞান ধীরে ধীরে সেটিকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে।

তবে এর সাথে কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। যদি মস্তিষ্কের ডেটা ভুল হাতে পড়ে, তাহলে ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার হতে পারে। তাই বিজ্ঞানীরা যেমন নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করছেন, তেমনি নিরাপত্তা নিয়েও কাজ করছেন।

সব মিলিয়ে বলা যায়, মস্তিষ্ক পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটারই নয়, ভবিষ্যতের প্রযুক্তির সাথে মিলেমিশে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। আর এই আশ্চর্য অঙ্গটিকে রক্ষা ও উন্নত করা আমাদেরই দায়িত্ব।

উপসংহার

মস্তিষ্ক আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নিয়ন্ত্রণ করে—আমরা কীভাবে দেখি, শুনি, অনুভব করি, এমনকি কীভাবে স্বপ্ন দেখি তাও মস্তিষ্কের মাধ্যমেই হয়। বিজ্ঞান যতই এগোচ্ছে, আমরা মস্তিষ্কের রহস্য ততই নতুনভাবে আবিষ্কার করছি।

এটি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটার হলেও যত্ন না নিলে দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। তাই পর্যাপ্ত ঘুম, সুষম খাবার, ব্যায়াম ও ইতিবাচক মানসিকতা দিয়ে মস্তিষ্কের যত্ন নেওয়া জরুরি।

ভবিষ্যতে প্রযুক্তি ও মস্তিষ্ক একত্রে নতুন যুগের সূচনা করতে পারে, কিন্তু এর সঠিক ব্যবহার ও নিরাপত্তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। মস্তিষ্কের শক্তিকে চিনতে পারলে আমরা নিজেদের জীবন আরও সুন্দর ও বুদ্ধিদীপ্তভাবে গড়ে তুলতে পারব।

Leave a Comment

You cannot copy content of this page