পড়াশুনা শেষ করার পর সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টা নিয়ে আমরা বিপাকে পড়ি তা হচ্ছে চাকরি করবো ? নাকি চাকরি দেব? কোনটি আমার জন্য সঠিক হবে? যেটাই বেছে নেই না কেন আমি কি আমার ক্যারিয়ারে সফল হতে পারব?তবে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমাদের জানতে হবে উদ্যোক্তা এবং চাকরি বলতে কি বোঝায়?
উদ্যোক্তা কাকে বলে?
নির্দিষ্ট পরিমান মূলধন ও সংগঠিত পরিকল্পনা নিয়ে নিজের ও অন্যের জন্য কর্মসংস্থান করেন যিনি তাকেই উদ্যোক্তা বলা হয়। একজন উদ্যোক্তার নতুন উদ্ভাবন এর দ্বারা সম্পদ ও অনুপ্রেরনা তৈরি হয়।
চাকরি বলতে কি বুঝি?
সহজ কথায় চাকরি হচ্ছে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অধীনে কাজ করা। যেখানে মালিক পক্ষের ইচ্ছাই আপনার ইচ্ছা। নির্দিষ্ট সময় এবং শ্রমের বিনিময়ে আপনি একটি নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ আয় করতে পারবেন।
যারা একটু ভিন্ন চিন্তা ভাবনা করতে আগ্রহী, চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করে, তাদের জন্য উদ্যোক্তা হওয়া সমীচীন। কারন এখানে ঝুকি থাকে, নতুন উদ্ভাবন তৈরি করতে হয়,সাফল্যের কোন সিমারেখা থাকেনা। পরিস্রম ও বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে টিকে থাকতে হয়। এখানে সম্ভাবনা অনেক, কিন্তু ঝুকির কোন বিকল্প নেই। সেই সাথে আয়ের ও কোন সিমাবদ্ধতা নেই।
আর যারা কোন প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করে প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ উপার্জন করে নিজের ও পরিবারের চাহিদা মেটাবেন। ঝড় বন্যা যাই হোক আপনার আয়ের উপর এর কোন বিরুপ প্রভাব পড়বেনা, সীমিত আয় দিয়ে জীবনযাপন করবেন, পরিবারকে সময় দিবেন, তারা চাকরি কে পেশা হিসেবে নিতে পারেন।এখানে আপনার বাড়তি কোন ঝুকি নিতে হবে না। পরিশ্রম করবেন বিনিময়ে পারিশ্রমিক পাবেন।
উদ্যোক্তা হওয়ার সুবিধা
একটা কথা আছে, বড় প্রতিষ্ঠানের কর্মী হওয়ার চেয়ে ছোট প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়া ভাল। কারন আপনার প্রতিষ্ঠান, আপনার পরিশ্রম অর্জিত জ্ঞান সবই আপনার। এছাড়া ও উদ্যোক্তা হওয়ার আরও কিছু সুবিধা নিচে তুলে ধরা হলঃ
স্বাধীনতা –
আপনার প্রতিষ্ঠান আপনার সিদ্ধান্ত। আপনি যখন উদ্যোক্তা হবেন, তখন প্রতিষ্ঠানের ভাল খারাপ সব দিক বিবেচনা করে স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।শুধু তাই নয়, আপনি আপনার কাজের ফাঁকে পরিবারকে ও সময় দিতে পারবেন , কারও অনুমতি নিতে হবে না।
নিরাপত্তা –
যেখানে প্রতিষ্ঠানের মালিক আপনি নিজেই সেখানে রাতা রাতি কেউ চাইলেই আপনাকে একটি সফল ব্যবসায় থেকে শূন্যে নামিয়ে দিতে পারবেনা। অর্থাৎ আর্থিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারাই এগিয়ে ।
আদেশদাতা –
একজন উদ্যোক্তা তার প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় বিষয়ে আদেশ নিষেধ প্রনয়ন করার অধিকার রাখেন। অন্য কারও হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে কোন নতুন প্রোজেক্ট চালু করা বা পুরাতন প্রজেক্ট বাতিল করা সবকিছুর আদেশদাতা আপনি নিজেই।
আয়ের পরিধি –
উদ্যোক্তা হওয়ার বড় সুবিধা হল এখানে আয়ের কোন সীমাবদ্ধতা নেই। পরিশ্রম ও জ্ঞানের যথাযোগ্য ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে আয়ের পরিধি বড় হতে থাকবে। উদ্যোক্তাদের আয়ের যেহেতু সীমাবদ্ধতা নেই তাই নিজের আর্থিক ক্ষমতায়ন দ্রুত ও কম সময়ের মধ্যে বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়।
অসুবিধা –
উদ্যোক্তা হওয়ার যেমন কিছু সুবিধা আছে তেমনি কিছু অসুবিধাও আছে। যেমনঃ
ঝুকি নেয়া –
উদ্যোক্তা হতে হলে ঝুকি নিয়েই কাজ করতে হবে। ঝুকির সম্ভাবনা আছে বলে বসে থাকা যাবেনা। কেননা তাহলে সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে না। ঝুকি নিলে আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকবে, এবং সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেবার মত ব্যবস্থাও আগে থেকেই করে রাখতে হবে।
ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া –
একজন উদ্যোক্তাকে প্রায়শই আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এবং ক্ষতি কাটিয়ে আবার ঘুরে দাড়াতে হয়। এবং নতুন ক্ষতির আশঙ্কা আছে জেনেও আবার মূলধনের ব্যবহার করতে হয়।
দায়িত্ব –
আপনি যেহেতু প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। তাই এর সমস্ত দায়িত্ব ও কিন্তু আপনারই। মাস শেষে কর্মীদের বেতন থেকে শুরু করে কোম্পানিকে সম্প্রসারণ করার সকল দায়িত্বই আপনাকে নিতে হবে। আপনার অধীনে যারা কাজ করবে তারা শুধুমাত্র নিজ নিজ কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করবে।
সময়ের অভাব –
একজন উদ্যোক্তাকে তার ব্যবসায়ের সকল বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়। বিভিন্ন প্রজেক্ট ভিজিট করা, অফিসের অভ্যন্তরিন মিটিং এ সময় দেয়া, এতকিছুর ভিড়ে তাই পরিবারের জন্য আলাদা করে সময় বের করা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাড়ায়।
চাকরির সুবিধা –
যদি আপনার মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা না থাকে, সাধারন জীবনযাপন করতে পছন্দ করেন। তাহলে চাকরিই আপনার জন্য মানানসই হবে। চাকরির ও অনেক সুবিধা আছে। যেমনঃ
কাজের সময় –
চাকরি করলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাড়ি ফেরা যায়। কেননা অফিস এর সময় নির্ধারিত থাকে। তাই অফিস শেষে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে পরিবারকে সময় দেয়া যায়। একারনে ঘরে বাইরে দুই জায়গাতেই সামঞ্জস্য রাখা সম্ভব হয়।
সঞ্চয় তৈরি –
চাকরি ক্ষেত্রে আয়ের পাশাপাশি প্রতি মাসে প্রভিডেন্ট ফান্ড বাবদ কিছু টাকা কেটে রাখা হয়। এতে যে ফান্ড তৈরি হয়, চাকরি শেষে তার দিগুন পরিমান টাকা হাতে পাওয়া যায়। শেষ জীবনে এই অর্থ অনেক কাজে দেয়।
মানসিক চাপ কম থাকে –
চাকরি করলে মানসিক চাপ তুলনামুলক অনেক কম।আপনাকে যে কাজের দায়িত্ব দেয়া হয় সেটুকু ঠিকভাবে করতে পারলেই হোল। তাছাড়া যেহেতু অফিসের টাইম শেষ হলে হাতে অনেক সময় থাকে এজন্য বিশ্রাম নেয়া যায়, যা মানসিক ভাবে প্রশান্তি আনে।
নিশ্চিত আয় –
চাকরি ক্ষেত্রে প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমান আয় নিশ্চিত থাকে। মাস শেষ হলেই আয় নিশ্চিত। তাই পরবর্তী মাসে কিভাবে নিজের ও পরিবারের আর্থিক প্রয়োজন পূরণ হবে এ বিষয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না। এজন্য মানসিক স্বাস্থ্যও ভাল থাকে।
অসুবিধাঃ
চাকরি ক্ষেত্রে অসুবিধা ও কম নয়। যেমনঃ
সীমিত আয় –
চাকরি ক্ষেত্রে দ্বায় যেমন সীমিত থাকে ঠিক তেমনি আয় ও সীমিত। আয়ের বৃদ্ধির জন্য আপনাকে এক বছর অপেক্ষা করতে হয়। তাই যে কোন শখ আহ্লাদ পূরণ করা খুবই কষ্টকর হয় এবং অনেক সময় সম্ভবই হয়না।
নিরাপত্তার অভাব –
বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোম্পানি থেকে যে কোন সময় সামান্য ভুলের কারনে আপনার চাকরি চলে যেতে পারে।আবার কোন দোষ ত্রুটি ছাড়াই কোম্পানি ইচ্ছা করলে আপনাকে অপসারন করতে পারে। সে ক্ষেত্রে আপনাকে সবসময়ই আর্থিক নিরাপত্তার শঙ্কা নিয়ে দিনযাপন করতে হবে।
স্বাধীনতা নেই –
চাকরি ক্ষেত্রে আপনার কোন স্বাধীনতা থাকবেনা, মালিক এর ইচ্ছাই শিরোধার্য। প্রয়োজনে ছুটির দিনেও অফিস করতে হবে, আবার ডিউটি টাইম শেষেও অফিসে থাকতে হতে পারে। সুতরাং বলাই যায় যে চাকরিজীবীদের কোন স্বাধীনতা নেই।
সবদিক বিবেচনা করে আপনার সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে।তবে যদি জীবনে অনেক বড় কিছু হতে চান তাহলে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করুন। কেননা যারা জীবনে বড় হয়েছে, তারা বেশিরভাগই উদ্যোক্তা। কিন্তু তাই বলে আগে পিছে না ভেবে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য নেমে পরলেই চলবে না। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আপনার ব্যবসায়িক জ্ঞান কতোটুকু আছে, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস আছে কিনা, পরিশ্রম করার মানসিকতা ও ধৈর্য, কাজ আদায় করার ক্ষমতা কতোটুকু, ঠাণ্ডা মস্তিষ্ক এই সবই একজন উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আপনার মধ্যে থাকা চাই। আর সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে বিষয় তা হচ্ছে মূলধন। সব গুনাবলি থাকার পর ও আপনার যদি মূলধন না থাকে তাহলে কিন্তু আপনি আপনার উদ্যোক্তা ক্যরিয়ার শুরুই করতে পারবেন না।
সেদিক থেকে পরামর্শ হচ্ছে আপনি আপনার ক্যরিয়ার চাকরি দিয়ে শুরু করতে পারেন, এবং যখন প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ হবে তখন আপনার উদ্যোক্তা জীবন শুরু করতে পারেন।ক্যরিয়ার হিসেবে চাকরি করা বা উদ্যোক্তা হওয়া কোনটা উত্তম এ বিষয়টি নির্ভর করে ব্যক্তি বিশেষের ওপর। চাকরি করবেন নাকি উদ্যোক্তা হবেন , কোনটি উত্তম এ বিষয়ে নিশ্চয়ই আপনি এখন একটি সিদ্ধান্তে পৌছতে পেরেছেন। যদি জ্বালা ঝঞ্ঝাটে যেতে না চান তবে চাকরি খুজুন, সেটাই আপনার জন্য উত্তম। আর যদি বৃহৎ স্বপ্ন বাস্তবে রুপ দিতে চান তবে উদ্যোক্তা না হয়ে সেটা সম্ভব নয়।