মানসিক স্বাস্থ্য ও কাজের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির উপায়

Spread the love

কখনো কি ভেবে দেখেছেন, আপনার মানুষিক স্বাস্থ্যর সাথে  আপনার কাজের উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে কিনা? আমাদের দেশের  বেশিরভাগ মানুষ এই সম্পর্কে জানেও কম আবার এ বিষয় তারা কিছুতা উদাসীন।আমরা শারীরিকভাবে অসুস্থ হলে যে পরিমান সহযোগিতা পেয়ে থাকি কিন্তু মানুষিক অসুস্থ হলে তেমনটা পাইনা । মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানাবিধ শারীরিক সমস্যা দৃশ্যমান হয়; সাথে আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ে।

মানসিক স্বাস্থ্য :

মানসিক স্বাস্থ্য হচ্ছে মনের একটি স্থায়ী অবস্থা, যেখানে ব্যাক্তি মানসিক ভাবে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকে  এবং নিজের সাথে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ব্যাক্তি নিজের শক্তিশালী ও দুর্বল দিক গুলো সম্পর্কে ধারণা থাকার ফলে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক বিষয়গুলো অর্জনে মানসিক সামর্থ্য পায়। । মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ‘হু’ এর ভাষ্যমতে , স্বাস্থ্য হল শরীর, মন এবং সমাজের ভাল দিকগুলির মেলবন্ধন। এই ভাবনার সঙ্গে রোগ বা দুর্বলতার দিকটি যুক্ত নয়। ‘হু’ আরও বলেছে যে, সুচিন্তার অধিকারী মানুষ তার দক্ষতা বাড়াতে সব সময়ই সচেষ্ট, এই দক্ষতাই তাকে জীবনের বিপর্যয়গুলির মোকাবিলা করে সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সাহায্য করে। উৎপাদনশীল কাজে সে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে এবং নিজের গোষ্ঠী ও সমাজের জন্যও অবদান রেখে যেতে পারে।

উৎপাদনশীলতাঃ

উৎপাদনশীলতা সম্পর্কে জানার আগে আমাদের উৎপাদন সম্পর্কে জানতে হবে।উৎপাদন অর্থ সৃষ্টি করা হলেও অর্থনীতিতে উৎপাদন বলতে কোন বস্তুর রুপান্তর বা পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে তার দ্বারা কোন উপযোগ বা অভাব পূরণের ক্ষমতা সৃষ্টি করাকে বোঝায়। আর উৎপাদনের মাধ্যমে কতটুকু উপযোগ সৃষ্টি করা হলো, তার আনুপাতিক পরিমাণকেই উৎপাদনশীলতা বলে।

 

মানসিক স্বাস্থ্য ও কাজের উৎপাদনশীলতা যে একে অন্যের পরিপূরক তা নিম্নে আলোচনা করা হলঃ

জীবনধারণের জন্য মানুষকে একটি  নির্দিষ্ট বয়সে কাজের সন্ধানে নামতে হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিবছর প্রায় ২০ থেকে ২১ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রবেশের সময়ে একজন মানুষকে যে তীব্র্র প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে আসতে হয় তা প্রায় সকলের ই জানা।

এই প্রতিযোগিতায় প্রত্যাশিত চাকরি না পাওয়ার ফলে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়ে।কাগজে কলমে একজন কর্মজীবীর কর্মঘন্টা ৮ ঘন্টা হলেও বাস্তবে এর চেয়ে বেশি সময় কর্মক্ষেত্রে কাটাতে হয়। অনেক সময় প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত চাপ নেবার বিষয়টিকে কর্মীর দক্ষতা ভেবে নিয়ে কাজের চাপ বাড়িয়ে দেয়।অতিরিক্ত চাপ একজন কর্মীর মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে যা তার উৎপাদনশীলতা, কমস্পৃহা এবং সৃজনশীলতাকে মারাত্মকভাবে বাঁধাগ্রস্ত করতে পারে।

বাংলাদেশের  কর্মক্ষেত্রে বুলিং, বডি-শেমিং , যৌন নিপীড়ন শিকারের মত অপরাধগুলো সংগঠিত হয়ে  থাকে। একজন কর্মী তার সহকর্মীদের দ্বারা বুলিংয়ের শিকার হলে তার মনোজগতে এক মারাত্মক পরিবর্তন আসতে পারে। সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, অন্যদের সাথে মিশতে পারে না, কর্মউদ্দীপনা হারিয়ে ফেলে। ফলে সে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ে। অনেকক্ষেত্রে কর্মীর ভেতরে অপরাধবোধ জন্ম নেয় এবং সে হতাশ হয়ে পড়ে। এ অবস্থা তাকে বিষণ্ণতার দিকে ধাবিত করে।

কর্মক্ষেত্রে  বিশেষকরে নারী কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এক বড় অন্তরায় হলো হয়রানি বা নিপীড়ন। কখনো কখনো এটি যৌন নিপীড়ন পর্যন্ত গড়ায়। এর ফলে একজন কর্মী কর্মক্ষেত্রেই নিরাপত্তাহীনতা এবং হীনমন্যতায় ভুগে। সে তার সমস্যা কথা কাউকে বলতে পারে না ভেতরে ভেতরে অসহায়বোধ করে। এর ফলে তার মধ্যে এক ধরণের ট্রমা তৈরি হয় যা তার মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে নষ্ট করে দেয়। সে তার সহকর্মীদের অবিশ্বাস করতে শুরু করে । অনেক সময় সে না চাইলেও নিজের ভালর জন্য সহকর্মীর ক্ষতি করে ফেলে। 

কর্মক্ষেত্রে বর্তমান সময়ের একটি পরিচিত কথা হলো ‘অফিস পলিটিক্স’ যেখানে কর্মীকে তাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার তোষামোদ করতে হয়, কর্তার মন জুগিয়ে চলতে হয় নতুবা যেকোনও সময় চাকরিচ্যুতির ভয় থাকে। এই পলিটিক্সে কারনে কর্মক্ষেত্রে সমান্তরালে অবস্থানরত কর্মী, কর্মকর্তা থেকে শুরু করে উর্ধ্বতন থেকে অধঃস্তন পর্যন্ত এক ধরনের লাগালাগি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ অপেক্ষা ব্যক্তিস্বার্থ স্বার্থের হাসিলের  উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। সমস্যা তৈরি হয় যখন একপক্ষ তার স্বার্থ উদ্ধারের জন্য অন্য পক্ষের উপর দায় চাপায়, অন্যের ক্ষতি করতে চায়। এই পলিটিক্সের কারণে কাউকে যেমন বিশ্বাস করা যায়না , তেমনি কারও কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠে না। ফলে কর্মীদের ভেতরে এক ধরনের অবিশ্বাসের জন্ম নেয়, ভীতি কাজ করে, কর্মী নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চায়, সমস্যার সমাধানে অগ্রসর না হয়ে সমস্যাকে পুষতে থাকে। এক সময় সে হতাশায় ভুগে।


এছাড়া বেতন কাঠামোগত কারণে, পারিবারিক প্রয়োজনে, কর্মক্ষেত্রের দূরত্ব বিবেচনায় অনেকেই পরিবার থেকে দূরে কর্মক্ষেত্রের আশেপাশে থাকে।নিজের পরিবার ,সমাজ ও বন্ধুবান্ধব , পরিজনে থেকে দূরে থেকে ব্যক্তি একাকী হয়ে পড়ে যা তাকে অবসাদগ্রস্ত ও বিষণ্ণ করে তোলে।এ অবস্থায় কর্মী তার কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়ে ।

কর্মজীবী মানুষদের মানুষিক স্বাস্থ্যগত বিষয় নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে। একজন কর্মীর কাজের মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে থাকে। বাংলাদেশে অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের মাঝেও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক অসচেতনতা রয়েছে।শারীরিকভাবে অসুস্থ হলে আমরা যে ধরনের সহযোগিতা পেয়ে থাকি কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয় ঘটলে অনেকের নিকট হতে এরকম তীর্যক মন্তব্য শুনতে হয়।

যেমনঃ 

১)মানসিক সমস্যা আবার কী, কাজ ফাঁকি দেবার ফন্দি।

২) মানসিক সমস্যা  জন্য আবার কাউন্সেলর, মনোবিদ বা মনোচিকিৎসক লাগে নাকি?”

৩)উনি পাগল হয়ে গেছেন নাকি?

৪) আমার সাথে কথা বল সব সমাধান করে দিব।

এধরনের কথায় কর্মী মানসিকভাবে মুষড়ে পড়তে পারে। অনেকক্ষেত্রে  পারিবারিক ও কর্মজীবনের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। অফিসের কাজে মনোযোগ দিতে না পারার ফলে তার উৎপাদনশীলতা সর্বোপরি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা নষ্ট হয়। এ সময়য়ে তার মানসিক সাপোর্ট ভীষণ প্রয়োজন পড়ে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অফিসের সহকর্মীদের কাছে সমস্যাগুলো খুলে বলতে পারেনা। কারণ এক্ষেত্রে  গোপণীয় বিষয় রয়েছে যা তার আত্মমর্যাদা, চাকরির নিরাপত্তার সাথে জড়িত থাকে। তাই এক্ষেত্রে পেশাদার মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন পড়ে।

নিচের কিছু পদক্ষেপ গ্রহনের মাধ্যমে আমরা ব্যাক্তিগত ও  প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে পারিঃ

ব্যাক্তিগত পদক্ষেপঃ

১) মনকে স্থির করতে মেডিটেশন।

২) পর্যাপ্ত ঘুমের কারন প্রতিদিনের কর্মক্ষমতা বাড়াতে ঘুম প্রয়োজন।

৩) শরীরচর্চার বিকল্প নেই কারন শরীরচর্চার করলে শারীরিক ও মানসিক ব্যথা উপশমকারী এন্ডোরফিন হরমোনের নিঃসরণ ঘটে এতে মন প্রফুল্ল থাকে।

৪) ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা।ডায়েরি লেখার মত অভ্যাসে করা। প্রতিদিনেই কিছু  ঘটনা লিখে রাখা যা মনের মধ্যে কৃতজ্ঞতা বোধ জাগিয়ে তোলে। এতে করে চিন্তাভাবনা ইতিবাচক হয়।

৫) রুটিন মেনে চলতে হবে।কাজ, বিশ্রাম, নিজের যত্ন এসব কিছু একটি রুটিন মেনে করা ভালো। এতে করে প্রতিদিনের অনিশ্চয়তা কাটিয়ে জীবন ফিরে পাবে ছন্দ।

৬) নিজেকে  অন্যদের কাছে প্রকাশ করতে হবেছবি আঁকা, লেখা অথবা গানের মধ্যে দিয়ে নিজের আবেগ প্রকাশ করতে হবে। এই অভ্যাস এক রকম থেরাপির মত কাজ করে।

৭) মনের দিক থেকে নিজেকে বেসামাল মনে হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।চিকিৎসকের কাছে যেতে দ্বিধা করা যাবে না কারন সুস্থ থাকতে কাউন্সেলিং, থেরাপি খুবই কার্যকর।

প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপঃ

১) মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালা থাকতে হবে।

২) কর্মীদের উপর মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক জরিপ চালাতে হবে।

৩) কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবি নিয়োগ করতে হবে।

৪) কর্মক্ষেত্রে বুলিং বন্ধ করতে হবে।

৫) সকল ধরনের নিপীড়ন বন্ধের জন্য প্রতিষ্ঠানকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

৬) রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।

পরিশেষে বলা যায় ব্যাক্তির কাজের ক্ষেত্রে কর্মউদ্দীপনা, কর্মস্পৃহা বেড়ে গেলে প্রতিষ্ঠান তথা রাষ্ট্র উপকৃত হবে।আর এটি তখনি সম্ভব যখন সে মানুষিক প্রশান্তিতে থাকবে।”মেন্টাল হেলথ কেয়ার ফর অল ,লেটস মেইক ইট অ্যা রিয়েলিটি”এ কথাটি মাথায় রেখে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।কর্মক্ষেত্রসহ সকল স্তরে নিজে ভালো থাকবো,অন্যকেও ভালো রাখব।

আরও পড়ুনঃ শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলার গুরুত্ব

Leave a Comment