আমাদের জীবনে স্মৃতিশক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষমতা। পড়াশোনা, কাজ কিংবা দৈনন্দিন জীবনে সব কিছু মনে রাখা প্রয়োজন হয়। কিন্তু অনেক সময় আমরা ভুলে যাই বা মনোযোগ ধরে রাখতে পারি না। আসলে স্মৃতিশক্তি শুধু পড়াশোনার জন্য নয়, সুস্থ জীবনযাপনের জন্যও দরকারি।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাদের খাওয়া-দাওয়ার সঙ্গে মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কিছু বিশেষ খাবার নিয়মিত খেলে আমাদের মস্তিষ্ক সতেজ থাকে, মনোযোগ বাড়ে এবং দীর্ঘ সময় ধরে তথ্য মনে রাখা সহজ হয়। আজ আমরা জেনে নেব, কোন কোন খাবার স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে এবং কেন এগুলো আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় রাখা উচিত।
১। মাছ ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার
স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির জন্য মাছকে বলা হয় সেরা খাবারগুলোর একটি। বিশেষ করে স্যামন, সার্ডিন, হেরিং, টুনা কিংবা আমাদের দেশে সহজলভ্য ইলিশ, রুই ও কাতলা মাছ মস্তিষ্কের জন্য খুবই উপকারী। এসব মাছে রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, যা মস্তিষ্কের কোষকে সক্রিয় রাখে এবং নতুন কোষ গঠনে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ খেলে শেখার ক্ষমতা বাড়ে, মনোযোগ স্থির থাকে এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।
আমাদের মস্তিষ্কের প্রায় ৬০% অংশই চর্বি দিয়ে তৈরি, যার মধ্যে বড় অংশ দখল করে রেখেছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড। এই উপাদান মস্তিষ্কে স্নায়ুর সংযোগ শক্তিশালী করে এবং তথ্য আদান-প্রদানে সাহায্য করে। তাই পরীক্ষার আগে বা পড়াশোনার সময় যদি মাছ খাওয়ার অভ্যাস থাকে, তাহলে পড়া বেশি মনে থাকে। শুধু তাই নয়, শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশেও ওমেগা-৩ অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে।
এছাড়া, মাছে থাকে ভিটামিন ডি ও বি-কমপ্লেক্স, যা মস্তিষ্কের সুস্থতার জন্য জরুরি। ভিটামিন ডি মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে এবং ভিটামিন বি স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতে সহায়ক। তবে মনে রাখতে হবে, অতিরিক্ত তেলে ভাজা মাছ নয়; সেদ্ধ, গ্রিল বা অল্প তেলে রান্না করা মাছই সবচেয়ে উপকারী।
যারা মাছ খেতে চান না, তারা বিকল্প হিসেবে বাদাম, চিয়া সিডস বা ফ্ল্যাক্সসিড থেকেও কিছুটা ওমেগা-৩ পেতে পারেন। তবে প্রাকৃতিকভাবে মাছই এর সেরা উৎস। তাই সপ্তাহে অন্তত ২–৩ বার মাছ খাওয়ার চেষ্টা করলে স্মৃতিশক্তি সতেজ থাকবে এবং পড়াশোনায় বা কাজে মনোযোগ বাড়বে।
২। বাদাম ও বীজ জাতীয় খাবার
স্মৃতিশক্তি বাড়াতে বাদাম ও বীজ জাতীয় খাবারকে অনন্য মনে করা হয়। আমন্ড, আখরোট, কাজু, পেস্তা—এসব বাদামে থাকে প্রচুর ভিটামিন ই, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ভিটামিন ই বিশেষ করে মস্তিষ্ককে বয়সজনিত ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনেক সময় মানুষ ভুলে যেতে শুরু করে, কিন্তু নিয়মিত বাদাম খেলে এই ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়।
আখরোটকে অনেক সময় “ব্রেইন ফুড” বলা হয়। কারণ আখরোটের আকৃতিই দেখতে মস্তিষ্কের মতো, আর এর ভেতরের ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড মস্তিষ্কের জন্য সরাসরি উপকারী। গবেষণায় দেখা গেছে, আখরোট খেলে শেখার ক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি দুটোই বাড়ে। অন্যদিকে, আমন্ডে থাকে প্রোটিন, ফাইবার এবং ভিটামিন বি, যা মস্তিষ্কে শক্তি জোগায় এবং মনোযোগ ধরে রাখতে সহায়তা করে।
শুধু বাদাম নয়, সূর্যমুখী বীজ, কুমড়ার বীজ বা ফ্ল্যাক্সসিডও মস্তিষ্কের জন্য চমৎকার। এসব বীজে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, জিঙ্ক এবং কপার পাওয়া যায়। জিঙ্ক মস্তিষ্কের স্নায়ুকে শক্তিশালী করে, আর ম্যাগনেসিয়াম মনকে শান্ত রাখে এবং শেখার ক্ষমতা উন্নত করে।
শিশু থেকে বয়স্ক সবাই সহজেই বাদাম ও বীজ খেতে পারে। সকাল বেলা দুধের সঙ্গে কয়েকটি আমন্ড, টিফিনে এক মুঠো আখরোট অথবা বিকেলের নাস্তার সময় কুমড়ার বীজ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুললে তা স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো। তবে বেশি পরিমাণে নয়, প্রতিদিন অল্প পরিমাণ নিয়মিত খাওয়াই উপকারী।
৩। ফলমূল—ব্লুবেরি, আঙুর ও অন্যান্য ফল
মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তি বাড়াতে ফলের ভূমিকা অনন্য। বিশেষ করে ব্লুবেরি, আঙুর, কমলা, আপেল ইত্যাদি ফল নিয়মিত খেলে মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে এবং মনোযোগ বাড়ে। ব্লুবেরিতে থাকে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, বিশেষ করে অ্যান্থোসায়ানিন, যা মস্তিষ্কের কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ব্লুবেরি খেলে শেখার গতি বৃদ্ধি পায় এবং স্মৃতিশক্তি দীর্ঘদিন ধরে তীক্ষ্ণ থাকে।
আমাদের দেশে ব্লুবেরি সহজলভ্য না হলেও আঙুর, কমলা, পেয়ারা, আপেল বা ডালিম মস্তিষ্কের জন্য খুবই উপকারী। আঙুরে থাকা রেসভেরাট্রল নামক উপাদান রক্ত চলাচল উন্নত করে, যা মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ায়। ফলে মনোযোগ বাড়ে এবং পড়াশোনার বিষয়গুলো বেশি মনে থাকে। অন্যদিকে, কমলায় প্রচুর ভিটামিন সি থাকে, যা মস্তিষ্ককে ফ্রি-রেডিক্যাল থেকে রক্ষা করে এবং মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
এছাড়া, আপেল খেলে শরীরের পাশাপাশি মস্তিষ্কেও শক্তি আসে। আপেলের খোসায় কুয়েরসেটিন নামক উপাদান থাকে, যা মস্তিষ্কের কোষকে দীর্ঘদিন তরতাজা রাখে। আর ডালিম রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত পুষ্টি সরবরাহ করে, যা স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
শিশুদের জন্য প্রতিদিন টিফিনে একটি আপেল বা কয়েকটি আঙুর দেওয়া যেতে পারে। বড়দের জন্য সকালের নাস্তায় বা বিকেলের নাস্তার সময় ফল খাওয়ার অভ্যাস খুবই ভালো। ফল শুধু স্মৃতিশক্তিই বাড়ায় না, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়। তাই খাদ্যতালিকায় প্রতিদিন কমপক্ষে একটি ফল রাখা উচিত।
৪। শাকসবজি—সবুজ পাতাওয়ালা শাক ও ব্রোকলি
স্মৃতিশক্তি বাড়াতে শাকসবজির গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে সবুজ পাতাওয়ালা শাক যেমন পালং শাক, লাল শাক, কলমি শাক কিংবা ব্রোকলি মস্তিষ্কের জন্য খুবই উপকারী। এসব শাকে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন কে, ভিটামিন সি, ফলেট (ফোলিক এসিড), আয়রন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা মস্তিষ্কের কোষকে সুস্থ রাখে এবং স্মৃতিশক্তি বাড়ায়।
পালং শাকে থাকা ফলেট নতুন স্নায়ু কোষ গঠনে সহায়তা করে। এটি মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করে এবং মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত সবুজ শাকসবজি খায়, তাদের স্মৃতিশক্তি তুলনামূলকভাবে ভালো থাকে এবং বয়স বাড়লেও স্মৃতিভ্রংশ হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।
অন্যদিকে, ব্রোকলিতে রয়েছে ভিটামিন কে এবং প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ভিটামিন কে স্নায়ুর সংযোগ উন্নত করে এবং নতুন তথ্য মনে রাখতে সাহায্য করে। আবার এতে থাকা সালফোরাফেন নামক উপাদান মস্তিষ্ককে প্রদাহ থেকে রক্ষা করে। শিশুদের পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়াতে ব্রোকলি বিশেষভাবে কার্যকর হতে পারে।
এছাড়া গাজর, টমেটো ও বেল পেপারও মস্তিষ্কের জন্য ভালো। গাজরে থাকা বিটা-ক্যারোটিন দৃষ্টিশক্তির পাশাপাশি স্মৃতিশক্তি রক্ষা করে। টমেটোতে থাকা লাইকোপেন মস্তিষ্কের কোষকে ফ্রি-রেডিক্যালের আক্রমণ থেকে বাঁচায়।
শিশুদের টিফিনে শাকসবজির স্যান্ডউইচ, ব্রোকলি দিয়ে স্যুপ কিংবা গাজর-টমেটোর সালাদ দেওয়া যেতে পারে। আবার বড়দের জন্য দুপুর বা রাতের খাবারে নিয়মিত শাকসবজি রাখা উচিত। শাকসবজি শুধু স্মৃতিশক্তিই নয়, সামগ্রিকভাবে শরীর ও মনের সুস্থতা বজায় রাখে।
৫। দুধ, ডিম ও সম্পূর্ণ শস্য
মস্তিষ্ককে সক্রিয় ও সতেজ রাখতে দুধ, ডিম এবং সম্পূর্ণ শস্যজাতীয় খাবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দুধে আছে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন বি-১২, যা মস্তিষ্কে শক্তি জোগায় এবং নতুন কোষ তৈরি করতে সাহায্য করে। ভিটামিন বি-১২ বিশেষভাবে স্নায়ুর কার্যকারিতা উন্নত করে, ফলে মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি দীর্ঘদিন সক্রিয় থাকে।
ডিম মস্তিষ্কের জন্য আরেকটি অসাধারণ খাবার। ডিমের কুসুমে থাকে কোলিন নামক উপাদান, যা মস্তিষ্কে নিউরোট্রান্সমিটার তৈরিতে সাহায্য করে। এই উপাদান শেখার ক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, নিয়মিত ডিম খেলে শিশুদের বুদ্ধি ও শেখার দক্ষতা বাড়ে। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও এটি স্মৃতিভ্রংশ কমাতে সহায়ক।
অন্যদিকে, সম্পূর্ণ শস্য যেমন—ওটস, ব্রাউন রাইস, গমের রুটি বা ভুট্টা মস্তিষ্কে ধীরে ধীরে শক্তি সরবরাহ করে। আমাদের মস্তিষ্ক মূলত গ্লুকোজ থেকে শক্তি পায়, আর এই শস্যগুলো ধীরে হজম হয় বলে দীর্ঘ সময় ধরে মস্তিষ্কে শক্তি দেয়। ফলে পরীক্ষার সময় বা দীর্ঘ সময় পড়াশোনা করার সময় মনোযোগ ধরে রাখা সহজ হয়।
শিশুদের নাশতায় এক গ্লাস দুধ, সঙ্গে একটি সেদ্ধ ডিম এবং ওটস বা গমের রুটি দিলে তা তাদের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি শরীরের সামগ্রিক সুস্থতার জন্যও ভালো। বড়দের জন্যও প্রতিদিন অন্তত একটি ডিম, দুধ বা দই এবং সম্পূর্ণ শস্য খাওয়ার অভ্যাস খুবই কার্যকর।
সুতরাং, দুধ, ডিম ও সম্পূর্ণ শস্য শুধু শরীর নয়, মস্তিষ্ককেও শক্তিশালী করে, যা পড়াশোনা, কাজ ও দৈনন্দিন জীবনে সফল হতে সাহায্য করে।
উপসংহার
আমাদের মস্তিষ্ক সুস্থ ও সক্রিয় রাখতে সঠিক খাবারের ভূমিকা অপরিসীম। মাছের ওমেগা-৩, বাদামের ভিটামিন ই, ফলের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, শাকসবজির ফলেট কিংবা দুধ-ডিমের কোলিন—সব মিলিয়ে এগুলো মস্তিষ্ককে শক্তি জোগায় এবং স্মৃতিশক্তি দীর্ঘদিন ধরে তীক্ষ্ণ রাখে।
ছোট শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক সবাই খাদ্যতালিকায় এসব খাবার রাখলে শেখার ক্ষমতা বাড়বে, মনোযোগ উন্নত হবে এবং বয়সজনিত স্মৃতিভ্রংশের ঝুঁকি অনেকটা কমবে। তাই প্রতিদিনের খাবারে সামান্য পরিবর্তন এনে আমরা স্মৃতিশক্তি বাড়াতে পারি সহজেই। সঠিক খাদ্যাভ্যাসই হতে পারে তীক্ষ্ণ স্মৃতির সবচেয়ে কার্যকর গোপন রহস্য।