পড়াশোনা মনে রাখার সহজ ও প্রমাণিত কৌশল

Spread the love

পড়াশোনা আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর একটি। আমরা সবাই চাই যে আমরা যেটা শিখি, সেটা ভালোভাবে মনে রাখতে পারি এবং প্রয়োজনে সহজে ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু অনেক সময় আমরা অনেক পড়াশোনা করি, তারপরও মনে রাখতে পারি না। এটা খুবই সাধারণ একটি সমস্যা। পড়াশোনার ক্ষেত্রে শুধু পড়া নয়, সেটা মনে রাখা এবং বুঝে নেওয়াও জরুরি।

পড়াশোনা মনে রাখার জন্য অনেক ধরনের কৌশল রয়েছে, কিন্তু সব কৌশল সবাইর জন্য কাজ নাও করতে পারে। তাই এমন কিছু প্রমাণিত কৌশল রয়েছে যা বিজ্ঞানসম্মত এবং দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষিত। এই কৌশলগুলো অনুসরণ করলে পড়াশোনার ফলাফল অনেক বেশি উন্নত হয় এবং আপনি সহজেই পড়া বিষয়গুলো মনে রাখতে পারেন।

আমরা এই লেখায় এমন কিছু সহজ ও কার্যকরী কৌশল নিয়ে কথা বলব, যা যেকোনো বয়সের মানুষ খুব সহজেই বুঝে নিতে পারবে এবং ব্যবহার করতে পারবে। ৭ বছরের বাচ্চা থেকে বড় সবাই এই পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে পড়াশোনার শক্তি বাড়াতে পারবে। এই কৌশলগুলো বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন গবেষণার ওপর ভিত্তি করে সাজানো হয়েছে।

পড়াশোনার সময় মনে রাখা কিভাবে শক্তিশালী করা যায়, কোন অভ্যাসগুলো গড়ে তোলা উচিত, এবং কিভাবে পড়ার পদ্ধতিকে আরও স্মরণশক্তি বৃদ্ধি করে তোলা যায় — এসব নিয়ে এই লেখায় বিস্তারিত আলোচনা থাকবে। আপনি যদি এই কৌশলগুলো নিয়মিত মেনে চলেন, তাহলে আপনার পড়াশোনার গুণগত মান অনেক উন্নত হবে এবং পড়া বিষয়গুলো স্মৃতিতে আটকে থাকবে দীর্ঘদিন।

চলুন শুরু করি পড়াশোনা মনে রাখার প্রথম ধাপ থেকে।

১। মনোযোগ দিয়ে পড়া এবং ফোকাস তৈরি করা

পড়াশোনা মনে রাখার সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি হলো মনোযোগ। যখন আমরা মনোযোগ দিয়ে পড়ি, তখন আমাদের মস্তিষ্ক পড়া বিষয়গুলোর তথ্য গ্রহণ করে এবং ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে পারে। কিন্তু অনেক সময় পড়ার সময় মনোযোগ অন্যদিকে চলে যায়—মোবাইল দেখায়, কথা বলতে মন যায়, বা অজান্তেই মনোযোগ হ্রাস পায়। এর ফলে পড়াশোনার তথ্য মনে রাখতে অনেক কষ্ট হয়।

মনোযোগ তৈরি করার জন্য প্রথমে পরিবেশকে ঠিক রাখা জরুরি। পড়ার জায়গা যেন শান্ত এবং ঝামেলা মুক্ত হয়। মস্তিষ্ক যখন বেশি শব্দ বা গোলমাল পায়, তখন তার কাজ করার ক্ষমতা কমে যায়। তাই একটি শান্ত এবং সুশৃঙ্খল পরিবেশ পড়াশোনার জন্য উপযুক্ত।

দ্বিতীয়ত, পড়ার সময় নিজের মনকে পুরোপুরি সেখানে রাখতে হবে। যদি মনোযোগ হারিয়ে যায়, একটু বিরতি নিন, চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিন, তারপর আবার পড়তে শুরু করুন। পড়ার সময় মোবাইল ফোন, টিভি বা অন্য যেকোনো বিভ্রান্তিকর জিনিস পাশে না রাখা ভাল।

তৃতীয়ত, পড়ার জন্য ছোট ছোট সময় নির্দিষ্ট করুন, একবারে অনেক সময় ধরে পড়া নয়। উদাহরণস্বরূপ, ২৫-৩০ মিনিট করে পড়ুন, তারপর ৫-১০ মিনিট বিরতি নিন। এই পদ্ধতিটাকে বলে ‘পমোডোরো টেকনিক’। এতে মন ভালোভাবে ফোকাস করতে পারে এবং ক্লান্তিও কম হয়।

আরো একটি উপায় হলো পড়ার সময় নিজের সাথে কথোপকথন করা, অর্থাৎ যা পড়ছেন তা নিজে নিজে উচ্চারণ করা বা ছোট করে সারমর্ম বলার চেষ্টা করা। এটি মনোযোগ বাড়ায় এবং তথ্য স্মৃতিতে ধরে রাখতে সাহায্য করে।

সুতরাং, পড়াশোনার প্রথম ধাপ হলো মনোযোগ গড়ে তোলা এবং পড়ার পরিবেশ ঠিক করা। মনোযোগ থাকলেই পড়া সহজে মনে থাকে এবং পড়াশোনা সফল হয়।

২। নিয়মিত পুনরাবৃত্তি – পড়া বিষয়গুলো মস্তিষ্কে গেঁথে রাখা

পড়াশোনার তথ্য মনে রাখতে হলে শুধু একবার পড়া যথেষ্ট নয়। আমরা যা পড়ি, তা বারবার আবারও দেখানো বা পড়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রক্রিয়াটাকে বলা হয় পুনরাবৃত্তি। নিয়মিত পুনরাবৃত্তি করলে মস্তিষ্ক সেই তথ্যগুলোকে অস্থায়ী স্মৃতি থেকে স্থায়ী স্মৃতিতে রূপান্তরিত করতে পারে।

কেন পুনরাবৃত্তি জরুরি? আমরা অনেক সময় নতুন কিছু শিখে থাকি, কিন্তু এক ঘণ্টা পর সেটা ভুলে যাই। কারণ মস্তিষ্ক একবার শিখে নেয়ার পর, যদি তথ্যগুলো নিয়মিত কাজে না লাগে বা পুনরায় না পড়া হয়, তাহলে তা দ্রুত মুছে ফেলে। পুনরাবৃত্তি করলে মস্তিষ্ক সেই তথ্যগুলোকে বারবার মনে করিয়ে দেয়, ফলে স্মৃতিতে সেটি শক্তিশালী হয়।

কিভাবে পুনরাবৃত্তি করবেন? প্রথমে যা পড়েছেন, ১-২ দিনের মধ্যে সেটা আবার একবার পড়ুন বা রিভিউ করুন। তারপর পরবর্তী সপ্তাহে আবার একবার দেখুন। এইভাবে মাঝে মাঝে তথ্যগুলো মনে করিয়ে দিলে তা স্মৃতিতে আটকে থাকে।

আরও কার্যকর পদ্ধতি হলো ‘স্পেসড রিপিটিশন’ (Spaced Repetition)। অর্থাৎ পড়াশোনার বিষয়গুলো মাঝেমাঝে সময়ের ব্যবধানে পুনরায় দেখা। এতে পড়া অংশগুলো মনে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।

পুনরাবৃত্তি করতে হলে সংক্ষিপ্ত নোট বা ফ্ল্যাশকার্ড তৈরি করতে পারেন। এতে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো সহজে চোখে পড়ে এবং বারবার পড়তে সুবিধা হয়।

এছাড়া, পড়ার পর নিজেকে প্রশ্ন করুন, যা পড়েছেন তা মনে আছে কিনা। নিজের উত্তর লিখে বা বলে দেখান। এই পদ্ধতিও মনে রাখার জন্য খুবই কার্যকর।

সুতরাং, নিয়মিত এবং পরিকল্পিত পুনরাবৃত্তিই পড়াশোনাকে সফল করার গোপন কৌশল। একবার পড়ে গেলে ভুলবেন না, বারবার মনে করিয়ে নিতে হবে।

৩। বিষয়বস্তুকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করা (Chunking Technique)

আমাদের মস্তিষ্ক একবারে অনেক বড় তথ্য একসাথে গ্রহণ করতে পারে না। তাই বড় বড় বিষয়কে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে পড়লে মনে রাখা অনেক সহজ হয়। এই পদ্ধতিটাকে বলা হয় Chunking, অর্থাৎ তথ্যকে ছোট ছোট “টুকরো” বা অংশে ভাগ করা।

ধরা যাক, আপনি ১০০ সংখ্যার একটি দীর্ঘ তালিকা বা একটি বড় বিষয় একবারে পড়ার চেষ্টা করছেন। মস্তিষ্ক সবকিছু একসাথে ধরতে পারবে না, ফলে অনেক কিছু ভুলে যেতে পারে। কিন্তু যদি সেই তালিকাটিকে ১০টি ১০ সংখ্যার ভাগে ভাগ করেন, তাহলে মনে রাখা অনেক সহজ হবে।

এই কৌশলটি আমরা ছোটবেলায় অনেক ব্যবহার করি। যেমন ফোন নম্বর মনে রাখার সময় সেটিকে ৩-৪ সংখ্যার ভাগে ভাগ করি। ঠিক একই পদ্ধতি পড়াশোনাতেও কাজে লাগে।

কিভাবে করবেন? প্রথমে বড় বিষয়টি নিয়ে আসুন এবং সেটাকে বিভিন্ন উপ-বিষয়ে ভাগ করুন। তারপর প্রতিটি অংশকে আলাদাভাবে মনোযোগ দিয়ে পড়ুন ও বুঝুন। পড়ার পরে প্রতিটি ছোট অংশের সারমর্ম লিখে নিন অথবা নিজে নিজে সেটি বলতে চেষ্টা করুন। এতে সেই অংশটি মস্তিষ্কে ভালোভাবে ঢুকে যাবে।

আরও একটি সুবিধা হলো, ছোট ছোট অংশে ভাগ করলে পড়ার সময়ও অনেক কম ক্লান্তি লাগে। কারণ একসাথে অনেক পড়ার চেয়ে ছোট ছোট অংশে পড়লে মন ভালো থাকে এবং পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ বজায় থাকে।

ছোট ছোট অংশে ভাগ করার মাধ্যমে আপনার পড়াশোনা হবে আরো সুসংগঠিত এবং স্মৃতিশক্তি বাড়বে। এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করলে যেকোনো জটিল বিষয়ও সহজে মনে রাখা যায়।

৪। সক্রিয় শেখার কৌশল ব্যবহার করা (Active Learning Techniques)

পড়াশোনাকে স্মরণীয় করতে এবং গভীরভাবে বোঝার জন্য শুধু পড়লেই হয় না, পড়ার সাথে সাথে অংশগ্রহণ করতে হয়। এটাকে বলা হয় সক্রিয় শেখা। সক্রিয় শেখার মাধ্যমে আমরা তথ্যকে শুধু শিখি না, বরং সেটাকে মস্তিষ্কে প্রক্রিয়াজাত করি এবং সেটির সঙ্গে যুক্ত থাকি।

সক্রিয় শেখার কিছু জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো:

  1. নিজের ভাষায় ব্যাখ্যা দেওয়া: পড়ার বিষয়বস্তু নিজে নিজে বুঝে নিয়ে সেটাকে সহজ ভাষায় পরিবারের সদস্য, বন্ধু বা নিজের কাছে বলুন। এতে আপনি তথ্যকে ভালোভাবে ধারণ করতে পারবেন।
  2. প্রশ্ন তৈরি করা: যেটা পড়ছেন, তার ওপর প্রশ্ন তৈরি করুন এবং নিজেই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করুন। এতে তথ্য গভীরভাবে মস্তিষ্কে জমা হয়।
  3. চিত্র বা ডায়াগ্রাম আঁকা: বিষয়টা বুঝতে পারলে তাকে ছবির মাধ্যমে সাজিয়ে নিন। অনেক সময় ছবির মাধ্যমে তথ্য মনে রাখা সহজ হয়।
  4. গ্রুপে আলোচনা: বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হয়ে পড়া বিষয় নিয়ে আলোচনা করুন। কারো প্রশ্ন শুনে বা নিজের কথা বলেও বিষয়টা মজবুত হয়।
  5. লেখে নেওয়া: পড়ার সময় গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো নোট করুন। শুধু পড়ার থেকে লিখলে মনোযোগ বাড়ে এবং স্মৃতিশক্তি বাড়ায়।

সক্রিয় শেখার মাধ্যমে পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ বেড়ে যায় এবং তথ্য মস্তিষ্কে ভালোভাবে গেঁথে যায়। এটি পড়াশোনার একটি শক্তিশালী ও প্রমাণিত পদ্ধতি।

তাই, পড়াশোনা করার সময় শুধু চোখ বন্ধ করে বা থাম থেকে না, বরং পড়া বিষয়ের সাথে নিজেকে সম্পূর্ণ যুক্ত রাখুন। নিজের ভাষায় বুঝতে চেষ্টা করুন, প্রশ্ন করুন এবং সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিখুন। এতে আপনার স্মরণশক্তি অনেক বাড়বে এবং পড়াশোনা হবে আরো ফলপ্রসূ।

৫। নিয়মিত বিশ্রাম এবং মস্তিষ্কের যত্ন নেওয়া

পড়াশোনার সময় শুধু পড়াই নয়, মস্তিষ্কের সঠিক বিশ্রামও খুব জরুরি। মস্তিষ্ক ক্লান্ত হলে তার কাজের ক্ষমতা কমে যায় এবং পড়া তথ্য মনে রাখতে অসুবিধা হয়। তাই নিয়মিত বিরতি নিয়ে মস্তিষ্ককে সতেজ রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পড়ার মাঝে প্রতি ২৫-৩০ মিনিট পর ৫-১০ মিনিট বিরতি নিন। এই সময়ে চোখ বন্ধ করুন, একটু হাঁটুন, বা শিথিল শ্বাস নিন। এতে মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালন বাড়ে এবং নতুন তথ্য গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয়।

আরো কিছু দরকারি অভ্যাস হলো:

  • পর্যাপ্ত ঘুম: ভালো ঘুম মস্তিষ্কের স্মৃতি সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়ায়। রাতে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করুন।
  • সঠিক খাদ্য: প্রোটিন, ভিটামিন, ওমেগা-৩ জাতীয় খাদ্য মস্তিষ্কের জন্য উপকারী। বাদাম, মাছ, ডিম ইত্যাদি বেশি খান।
  • জলপান: শরীর এবং মস্তিষ্ক সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
  • যোগব্যায়াম ও মেডিটেশন: নিয়মিত যোগব্যায়াম ও ধ্যান করলে মন শান্ত থাকে এবং ফোকাস বাড়ে।

মস্তিষ্কের যত্ন নিলে পড়াশোনার ফলও ভালো হয়। তাই শুধু পড়ার প্রতি যত্ন নয়, শরীর এবং মন দুটোই ঠিক রাখতে হবে।

পড়াশোনা মনে রাখার এই পাঁচ ধাপ মেনে চললে আপনার শেখার গুণগত মান উন্নত হবে এবং পড়া অনেকদিন স্মৃতিতে থাকবে। প্রতিটি ধাপের গুরুত্ব বুঝে নিয়মিত অভ্যাস করলে পড়াশোনা অনেক সহজ এবং মজার হয়ে উঠবে।

উপসংহার: 

পড়াশোনায় সফল হওয়ার জন্য শুধু বেশি পড়া নয়, স্মৃতিশক্তিকে শক্তিশালী করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই লেখায় আমরা পড়াশোনা মনে রাখার পাঁচটি সহজ ও প্রমাণিত ধাপ আলোচনা করেছি — মনোযোগ দিয়ে পড়া, নিয়মিত পুনরাবৃত্তি, বিষয়বস্তুকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করা, সক্রিয় শেখার কৌশল ব্যবহার, এবং মস্তিষ্কের যথাযথ বিশ্রাম ও যত্ন নেওয়া।

যখন এই কৌশলগুলো নিয়মিত ও ধৈর্যের সঙ্গে পালন করবেন, তখন পড়াশোনার তথ্য আপনার মস্তিষ্কে গভীরভাবে গেঁথে যাবে এবং দীর্ঘদিন স্মৃতিতে থাকবে। এতে পড়াশোনার চাপ কমবে, আত্মবিশ্বাস বাড়বে এবং সফলতা সহজলভ্য হবে।

সবার জন্য মনে রাখার এই কৌশলগুলো খুবই কার্যকর এবং ব্যবহারযোগ্য। তাই আজ থেকেই এই পদ্ধতিগুলো মেনে চলার অভ্যাস গড়ে তুলুন, আর পড়াশোনাকে আরও ফলপ্রসূ ও আনন্দদায়ক করে তুলুন।

আপনার শেখার যাত্রা হোক সফল, মেধাবী আর স্মরণশক্তিতে সমৃদ্ধ।

Leave a Comment

You cannot copy content of this page