বনভোজন রচনা

Spread the love

বনভোজন হলো প্রকৃতির কোলে এক আনন্দঘন আড্ডা। ছুটির দিনে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, বা সহকর্মীদের সাথে বনভোজন যাওয়ার পরিকল্পনা করা যায়। বনভোজন যাওয়ার আগে বনভোজনস্থলের অবস্থান, পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি সম্পর্কে জেনে নেওয়া ভালো। বনভোজন যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার, পানীয়, ওষুধ, অন্যান্য সরঞ্জাম ইত্যাদি সঙ্গে নিতে হবে। বনভোজনস্থলে পৌঁছে পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। বনভোজন উপভোগ করার পাশাপাশি প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করা উচিত। বনভোজন শেষে বনভোজনস্থলের পরিবেশ যেন দূষিত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

বনভোজনের গুরুত্ব

সাধারণভাবে বনভোজের অর্থ বনে খাওয়া। আসলে আগেকার দিনে প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবন থেকে ছুটি নিয়ে সবাই মিলে বনে গিয়ে রান্না-বান্না করত। বনে খাওয়ার প্রথা বদলে গেলেও বনের নাম, চরিত্র ও তাৎপর্য বিন্দুমাত্র বদলায়নি। এটা সত্য যে জীবনের ব্যস্ততা থেকে জীবনের একটি নিঃশ্বাস খুঁজে পাওয়ার সবচেয়ে দরকারী উপায় হল ভ্রমণ।

বনভোজন একটি আনন্দঘন ও উপভোগ্য অভিজ্ঞতা। এটি শুধুমাত্র খাওয়া-দাওয়ার জন্য নয়, বরং প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার এবং বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় কাটানোর জন্যও একটি সুযোগ। বনভোজনের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। নিম্নে এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হল

১। শরীর ও মনকে সতেজ করে তোলে: পিকনিকের মাধ্যমে আমরা প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করি। এতে আমাদের মন ভালো থাকে এবং শরীর ও মন সতেজ হয়ে ওঠে।

২। বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ করে দেয়: বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্যদের সাথে একসাথে সময় কাটাতে পারি বনভোজনের মাধ্যমে। এতে আমাদের সম্পর্ক আরও মজবুত হয়।

৩। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ করে দেয়: আমরা প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারি। এতে আমাদের মন ভালো থাকে এবং আমরা প্রকৃতির প্রতি আরও ভালোবাসা অনুভব করি বনভোজনের মাধ্যমে।

৪। মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে: বনভোজনের মাধ্যমে আমরা দৈনন্দিন জীবনের চাপ থেকে কিছুটা দূরে থাকতে পারি। এতে আমাদের মানসিক চাপ কমে যায়।

বনভোজনের পরিকল্পনা এবং স্থান নির্বাচন

বনভোজনের পরিকল্পনা

বনভোজন একটি আনন্দঘন ও উপভোগ্য অভিজ্ঞতা। ছুটির দিনে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, বা সহকর্মীদের সাথে বনভোজন যাওয়ার পরিকল্পনা করা যেতে পারে। বনভোজনের পরিকল্পনা করার সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলি মাথায় রাখা উচিত:-

১। বনভোজনের তারিখ, সময় এবং স্থান নির্ধারণ করা।

২। কতজন লোক যাবেন তা নির্ধারণ করা।

৩। প্রয়োজনীয় খাবার, পানীয়, ওষুধ, অন্যান্য সরঞ্জাম ইত্যাদির তালিকা তৈরি করা বনভোজনের জন্য।

৪। বনভোজনের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করা।

৫। পিকনিকের জন্য উপযুক্ত পোশাক ও জুতা পরার ব্যবস্থা করা।

বনভোজনের জন্য স্থান নির্বাচন করার সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলি মাথায় রাখা উচিত

১। বনভোজনের স্থানটি অবশ্যই সুন্দর ও মনোরম হতে হবে।

২। স্থানটি অবশ্যই পরিবেশবান্ধব হতে হবে।

৩। বনভোজনের স্থানটি অবশ্যই নিরাপদ হতে হবে।

৪। পিকনিকের স্থানটি অবশ্যই আপনার এবং আপনার সঙ্গীদের পছন্দের হতে হবে।

৫। বাংলাদেশে বনভোজনের জন্য অনেক সুন্দর ও মনোরম স্থান রয়েছে। 

বনভোজনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি বনভোজনের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করা। সেই উদ্দেশ্যই সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায়বেলা অংশে সকলে  আলোচনায় বসলাম। দীর্ঘ আলোচনা করার পর সকলের সম্মতিতে স্থির করা এই বছর আমাদের বনভোজনের উদ্দেশ্যে বরিশালের ত্রিশ গোডাউন। ত্রিশ গোডাইন জায়গাটা বরিশালের ঐতিহ্য কীর্তনখোলা নদীর তীরে আবস্থিত। 

স্টুডেন্টদের জন্য মিনি হল রুম নির্মাণ করা হয়েছে। ওয়াপদার ভেতরে রাস্তা, টর্চার সেল সংরক্ষিত। এছাড়া পুরো কম্পাউন্ডটি দেয়াল বন্ধনী দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। নদীতীরবর্তী ত্রিশ বিঘা জমির উপর একটি স্মৃতিস্তম্ভ ও রিভার ভিউ পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। এসব দেখে মানুষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা জানতে পারে এবং কীর্তনখোলা নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে।

দলবেঁধে বনভোজনের গন্তব্যে পৌঁছানো

নির্দিষ্ট দিনে সকলে মিলে একসাথে বনভোজনে যাওয়ার জন্য একটি লঞ্চ ভাড়া করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট দিনে সকাল সাড়ে ছটার মধ্যে সকলে নির্দিষ্ট স্থানে এসে হাজির। তারপর সেই ভাড়া করা লঞ্চটিতে আমরা সবাই বনভোজনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ঘন্টাখানেক চলার পর পর থেকেই লঞ্চ জানালার বাইরের দৃশ্য ক্রমশ বদলে যেতে শুরু করল। আস্তে আস্তে আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের লঞ্চ ধীরে ধীরে শহরের সীমানা ছাড়িয়ে সবুজের রাজ্যে প্রবেশ করছে।

অবশেষে  আমরা আমাদের গন্তব্য  এসে পৌঁছলাম। সারাদিনের রান্না বান্না এবং খাওয়া-দাওয়ার সরঞ্জাম আমরা আসার সময় বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলাম। লঞ্চ থেকে সেইসব নামিয়ে সামান্য হাঁটাপথে আমরা রওনা দিলাম নদীর দিকে। খানিক দূর যাওয়ার পরই দেখতে পেলাম নদীর ধারে কিছু কিছু স্থান বনভোজনের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে আছে। আমরা আমাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে সকল জিনিসপত্র নিয়ে উপস্থিত হলাম।

সকাল বেলা নদীর ধারের পরিবেশ

সকালে নদীর পরিবেশ বেশ মনোরম ও শান্ত থাকে। সূর্যের আলো নদীর জলে প্রতিফলিত হয়ে নদীর জলকে ঝিকিমিকি করে। নদীর তীরে জলের কলকল ধ্বনি মনকে শান্ত করে। নদীর তীরে বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করা এক অসাধারণ অনুভূতি। সকালে নদীর জল থাকে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। নদীর তলদেশে থাকা মাছ, শামুক, কাঁকড়া ইত্যাদি প্রাণী সহজেই দেখা যায়। নদীর তীরে থাকে নানা রকমের গাছপালা। গাছের পাতায় জমে থাকা শিশির সূর্যের আলোয় ঝিকিমিকি করে।

সকালে নদীতে থাকে নানা রকমের পাখি। পাখিরা ডাকতে ডাকতে নদীর উপর দিয়ে উড়ে যায়। নদীর তীরে বসে পাখির ডাক শুনতে বেশ ভালো লাগে। সকালে নদীতে নৌকা চলাচল কম থাকে। তাই নদীতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করে। সকালে নদীতে ঘুরে বেড়ানো বেশ উপভোগ্য।

নৌকা চালানোর অভিজ্ঞতা

পিকনিকের জন্য নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে আমরা কেউ নাস্তা সেরে আশেপাশে ঘুরে বেড়াতে বের হলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি নদী থেকে একটা ছোট হ্রদ তৈরি হয়েছে। ভোজসভায় আগতদের জন্য বোটিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের হৃদয় আনন্দে নেচে উঠল। আমরা দুটি নৌকা ভাড়া করে বোটিংয়ের জন্য নেমে পড়লাম। নেমে এসে বুঝলাম, নদী থেকে পানি আনার খালের কারণে নদীর বিভিন্ন মাছ এই লেকে চলে। তাছাড়া লেকের পানিতে কিছু রাজহাঁস চরে বেড়াচ্ছে যা এখানকার পরিবেশকে করেছে আরও মনোরম। প্রায় ঘণ্টা খানেক বোটিং করার পর আমরা যুদ্ধে ক্লান্ত বিজয়ী সৈনিকের মতো আমাদের নির্ধারিত পিকনিক স্পটে ফিরে এলাম।

একসাথে রান্নাবান্না ও খাওয়া-দাওয়া

ফিরে এসে দেখলাম দুপুরের খাবার রান্না শুরু হয়ে গেছে। আমরা সাহায্যের জন্য কিছু পরিবারের বন্ধুদের কাছে পৌঁছেছি। পিকনিকে গিয়ে একসাথে রান্না ও খাওয়ার আনন্দই আলাদা। দুপুরের খাবারের মধ্যে রয়েছে স্থানীয়দের কাছ থেকে সংগ্রহ করা দেশি মুরগির গরম ঝোল, ডালের তরকারি এবং ভাত। আমরা বাড়ি থেকে ডাল, তরকারি, চাল নিয়ে এসেছি। এরপর মুখ মিষ্টি করতে বাঙালির পরম প্রিয় ‘রসগোল্লা’। খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘাসের ওপর বিছানো মাদুরের ওপর বিশ্রাম নিতে বসতেই সূর্য আকাশে বিকেলের আগমনের ঘোষণা দিচ্ছিল।

বিকেলের আড্ডা ও খেলাধুলা

খাওয়া-দাওয়া সেরে বিশ্রাম নিতে বসলাম, কিন্তু ভোজের সময় বিশ্রাম বলে কিছু নেই। মাদুরে বসে গানের আসর শুরু হলো। আমাদের পরিবারের এক বন্ধু তার গিটার নিয়ে এসেছে। তিনি গিটার বাজিয়ে এবং বিভিন্ন গান গেয়ে আমাদের আপ্যায়ন করতেন। তখন আমার এক মামা সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেন।

 তারপর আমরা কয়েকজন একসাথে কিছুক্ষণ খেলতে গেলাম। সঙ্গে থাকা ব্যাডমিন্টন র‌্যাকেট এবং ফুটবল খেলা ছাড়া ভোজ সম্পূর্ণ হয় না। খাওয়া-দাওয়ার পর একটা ছোট শ্বাস-প্রশ্বাসের খেলা আমাদের সবাইকে ক্লান্ত করে দিল। অবশেষে খেলাধুলা ছেড়ে আমরা ফিরে এলাম চলমান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সেখানে আবৃত্তি হচ্ছে রবি ঠাকুরের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ।

নদীতীরে সন্ধ্যার অনুভূতি

ইতিমধ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলান দিয়ে আছে। সন্ধ্যার আমেজ ঢেলে পড়ছে চারদিকে। আমাদের চারপাশে যারা ভোজসভায় এসেছেন তারা এক এক করে গুছিয়ে বাড়ির দিকে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে লঞ্চের দিকে যাচ্ছে। আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তখনও চলছে। মা তখন গাইলেন ‘ভুলনা আমায় বন্ধু তোমার পথের সাথিকে চিনে নিও ’।

দূরের গ্রাম সন্ধ্যার অন্ধকার আর কুয়াশায় অন্ধকার হয়ে গেল। নদীর ওপারের  তখন আর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ পর নদীর কল কল ধ্বনি শব্দ শোনা গেল। এসব এলাকায় সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয় শিয়ালের ডাক। গ্রামের এক বাড়ি থেকে শঙ্খধ্বনি ভেসে আসছিল। নদীর তীরের মধুর পরিবেশ উপভোগ করে এবং গান শোনার পর, আমরা একসাথে ফিরে এসে জিনিসপত্র গুছিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

উপসংহার

সেদিন বনভোজন শেষে লঞ্চে করে বাড়ি ফেরার সময় আমাদের সবার মন এক অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতিতে ভরে উঠেছিল। প্রত্যাবর্তনের শান্ত পরিপূর্ণতায় আমাদের উদ্দাম উচ্ছ্বাস ছেয়ে গেছে। সেদিনের সাথে বাসায় ফিরে আসার অনুভূতিটা আমার মনে অনেক দিন ধরে জায়গা করে নিয়েছে। সেই সময় আমরা বাড়িতে এসে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, এখন থেকে প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে আমরা বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করব যেখানে পুরো পরিবার পিকনিকের জন্য জড়ো হয়।