আমরা এমন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি যখন বিশ্বব্যাপী বাড়ছে মানসিক চাপ শুধুমাত্র কাজের চাপের কারণে।বেঁচে থাকার প্রয়োজনে দিন দিন বাড়ছে কাজের চাহিদা সেই সাথে বাড়ছে চাপ।চাইলেই কাজ থেকে অব্যাহতি নিতে পারিনা কারণ জীবন যাত্রার মান এতটাই কঠিন হয়ে পড়েছে যে প্রতিনিয়ত আমাদের কাজের সন্ধানে থাকতে হয়।একটা কাজ দিয়ে কখনো কখনো চলা সম্ভব হয় না পাশাপাশি আরও দু একটা কাজের সন্ধান করতে হচ্ছে।যার ফলে বাড়ছে কর্মক্ষেত্রে চাপ।ছেলে মেয়েরা বড় হওয়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে তাদের কাজ আর দায়িত্ব। ফলে কর্মস্থলে,সংসার,পরিবারে বেড়ে যায় তাদের কাজের চাপ। অফিসে ঠিকভাবে কাজ করতে না পারলে টিকে থাকা দায়। চিন্তায় চিন্তায় আর টেনশনে রাতের পর রাত ঘুম হয় না। সকালে অফিসে গিয়ে মেজাজ খিট্মিটে থাকে কাজে মন বসেনা,হারাতে হয় চাকরিটা। এর প্রভাব পড়ছে শরীরের উপর এবং মনের উপর।
মহীলাদের জন্য তো যেকোন কর্মক্ষেত্রই অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। একদিকে ঘর সংসার অন্যদিকে অফিসে পুরুষের পাশাপাশি সমান তালে তাল মিলিয়ে কাজ করা। শুধু কি তাই ! অফিসে থাকলে সংসারের চিন্তা আর ঘরে থাকলে অফিসের চিন্তা। কারণ অফিসে ভুল হলে বসের ঝাড়ি আর সংসারে ভুল হলে পরিবারের লোকজনের ঝাড়ি মেয়েদের ছাড় নেই কোন খানেই, ফলাফল মেন্টাল স্ট্রেস ।
তাহলে কি আমরা কাজ করবো না? অবশ্যই করবো।প্রতিষ্ঠানের চাহিদা ,অতিরিক্ত দায়িত্ব,সেই সংগে পরিবারের দায়িত্ব এর মধ্য দিয়েই আমাদের কাজ করে যেতে হবে।আর অতিরিক্ত কাজের চাপ থেকে মুক্তি পেতে আমরা নিচের পদক্ষেপগুলো অনুস্মরণ করতে পারি।
১। কোরান তিলাওয়াত
ফজরের নামাজের পর কোরান তিলাওয়াতের মাধ্যমে আমরা দিনের শুরু করতে পারি।এতে মনের মধ্যে এক ধরনের প্রশান্তি মিলে আর কাজের ক্ষেত্রে আসে আল্লাহ সুবহানুতায়ালার বরকত।
২। সঠীক পরিকল্পনা
দিনের শুরুতেই আমাদের কাজের একটি পরিকল্পনা তৈরি করে নিতে হবে যে, আজ সারাদিন আমি কি কি কাজ করবো,কোন কাজের পর কোন কাজটি করবো।পরিকল্পনা মাফিক কাজ করলে আমাদের সময় অনেকখানি বেঁচে যাবে এবং কাজটিও হবে অনেক গোছানো এবং সুন্দর।এর ফলে মানসিক কোন চাপ থাকবেনা বরং মন থাকবে ফুরফুরে।
৩। সময়ের সঠিক ব্যবহার
যথাযথ সময়ে কাজ শুরু এবং শেষ করতে পারলে কাজের মধ্যে কোন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় না কাজটি ঠিকঠাক মতো শেষ হয়।সময় মতো কাজটি শেষ করতে পারার কারনে মনের দিক থেকে আসে একটা প্রশান্তি।ফলে মানসিক চাপ থাকে না। তাই চেস্টা করতে হবে যথাযথ সময়ে কাজ শুরু এবং শেষ করা।
৪। কাজের ফাঁকে বিরতি নেয়া
একটানা কাজ না করে কাজের ফাঁকে ১০ মিনিট ব্রেক নেয়া যেতে পারে। ১০ মিনিট মানে ১০ মিনিট খেয়াল রাখতে হবে কারন অতিরিক্ত ব্রেক নিয়ে নিলে আবার কাজ থেকে মন চলে যায়। দুই ঘন্টা কাজ করার পর ১০ মিনিট ব্রেক নিয়ে নিলেন।
৫। জানতে উৎসাহী হওয়া
কর্মক্ষেত্রে নতুন হলে কাজ করতে গিয়ে অনেক ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় ।সংকোচ বা জড়তার কারণে সহকর্মীদের কাছ থেকে সহযোগীতা নিতে মন সাঁয় দেয় না তখন মানসিক চাপে থাকতে হয়। তাই কোন ধরনের সংকোচ বা জড়তা না করে জেনে নিতে হবে নিজের কাজের ব্যাপারে সহকর্মীদের কাছ থেকে এতে স্ট্রেস ফ্রী হওয়া যায়।
৬। কাজ থেকে ছুটি নেয়া
দীর্ঘ কাজের চাপে স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের মধ্যে ্মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় ফলে কমে যায় কাজের গতি ,কাজের প্রতি সৃষ্টি হয় এক ধরনের অনিহা। এমন সময় দুই একদিনের ছুটি নেয়া যেতে পারে। বাইরে কোথাও বেড়াতে যেতে পারেন অথবা পরিবারের সাথে সময় কাটাতে পারেন।
৭। ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা
ক্যালেন্ডারে সব গুরুত্বপূর্ণ তারিখ এবং ইভেন্ট ক্যালেন্ডারে মার্ক করে রাখা যেনো পরে বিভ্রান্তিতে পড়তে না হয়। বসের জন্মদিন, সহকর্মীদের জন্মদিন বা প্রমোশন হলে তাদের উইশ করে তাদের খুশি করতে পারলে নিজের মনের মধ্যে এক ধরনের আনন্দ কাজ করে।
৮। সম্পর্কের যত্ন নিতে হবে
অফিসের সহকর্মী, ক্লায়েণ্টদের সম্পর্কে জানতে হবে। কিভাবে তাদের ভালো সেবা দেয়া যেতে পারে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা এবং তাদের মতামত নেয়া ।বসের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করা কোম্পানী বিষয়ে ।পরস্পর মতামত আদান প্রদানে এবং কথোপকথনে স্ট্রেস কমে যায়।
৯। অহেতুক দুশ্চিন্তা না করা
অহেতুক দুশ্চিন্তা দৈনন্দিন কাজের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলে। অহেতুক দুশ্চিন্তা অনেকটা চক্রের মতো ।যত দূর করতে চাইবেন ততই জেঁকে ধরবে। অতিরিক্ত কাজের স্ট্রেস থেকে আসে অহেতুক দুশ্চিন্তা। তাই খেয়াল রাখতে হবে অহেতুক দুশ্চিন্তা যেনো আমাদের কাজের গতি কমিয়ে না দেয়।
১০। অফিস যাওয়ার পথে গান শুনুন বা বই পড়ুন
অফিসে গিয়েই অনেক কাজ করতে হবে এমন ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।আর এর জন্য অফিসে যাওয়ার পথে গাড়িতে, বাস বা ট্রেনে পছন্দের গান শোনা যেতে পারে। এগুলো অফিসের কাজের ভাবনা থেকে দূরে রাখে।মনও থাকে প্রফুল্ল।
১১। নিজেকে সময় দিন
সারাদিন ব্যস্ততার পরও নিজের জন্য কিছুটা সময় রাখুন। কিছুক্ষনের জন্য একদম একা হয়ে যান। গান শুনুন বা নিজের পছন্দের কোন কাজ করুন।
১২। ব্যায়াম করুন
অফিস শেষে কিছুটা সময় ব্যায়াম করা যেতে পারে। এ সময় শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম এবং পেশির ব্যায়াম করা যেতে পারে। এই দুটো ব্যায়াম কাজের উত্তেজনা থেকে রেহাই দেয়।
১৩। সময়ের কাজ সময়ে শেষ করা
সময়ের কাজ সময়ে শেষ করা উত্তম। যখন কোন প্রতিবেদন বা প্রকল্প তৈরি করবেন তখন সেটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা কারণ কাজ জমিয়ে রাখলে চাপ বাড়ে।চেস্টা করা উচিৎ অফিস টাইমের মধ্যেই সব কাজগুলো শেষ করা। অফিসের কাজ বাসায় নিয়ে এলে পরিবার বা ব্যাক্তিগত সম্পর্ক গুলো ক্ষতি হতে পারে।
১৪। দিন শেষে সফলতার স্বাদ নেয়া
সম্প্রতি ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে “দিন শেষে কয়েক মিনিট কাজের সফলতা গুলো ভাবুন।যে সব কাজ আপনি শেষ করেছেন এবং যে কাজগুলো ভালো হয়েছে সেগুলো নিয়ে ভাবুন। একটি নোট খাতায় লিখেও রাখতে পারেন।এটা অফিস থেকে বের হওয়ার পরও আপনাকে একটি ভালো অনুভূতি দেবে।”
১৫। কাজের বাইরে অনুষ্ঠান
চমৎকার কোন ফুডবল ম্যাচ, রোমান্টিক ডিনার, বাসার কোন পার্টি যাই করুন না কেনো অফিস সময়ের পরে করুন এতে যথাযথ ভাবে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবেন। এগুলো কাজের একঘেয়েমি দূর করে।
১৬। ডিপ ব্রিদিং মেডিটেশন
অনেক সময় দেখা যায় প্রেজেন্টেশন বা মিটিং এর আগে মনে মনে বেশ চাপের মধ্যে থাকেন। এই সময় পাঁচ মিনিট ডিপ ব্রিদিং মেডিটেশন করলে এমন পরিস্থিতি থেকে রিলিফ পাওয়া যায়। ডিপ ব্রিদিং একদিকে যেমন স্নায়ুকে নিয়ন্ত্রনে রাখে তেমনি কঠিন পরিস্থিতিতে নিজেকে শান্ত রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও মেডিটেশন যেকোন চাপ কমাতে সাহায্য করে।
১৭। ভিসুয়্যাল মেডিটেশন
পরিস্থিতি থেকে পালানো সম্ভব নয় কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য কল্পনায় নিজের পছন্দের জায়গাটিতে চলে যাওয়া যায়। পাঁচ মিনিট এই পদ্ধতি অনুস্মরণ করে শরীর ও মনের চাপ কমানো সম্ভব।
১৮। সব সময় পজিটিভ থাকা
পজিটিভ চিন্তা ভাবনা আমাদেরকে মনের জোর দেয়, এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা দেয় এবং স্ট্রেস নিয়ন্ত্রনে রাখে। তাই জীবনকে সৎ ভাবে উপভোগ করতে শিখুন, প্রতিদিন সব কিছুর মাঝে ইতিবাচক জিনিস খুঁজুন, আশে পাশের মানুষ কি বলবে সে দিকে কান দিবেন না। ইতিবাচক চিন্তা করলে আমাদের জীবনেও ধীরে ধীরে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
১৯। রঙ নির্বাচন
নির্দিষ্ট কিছু রঙ রয়েছে যেমন- নীল, সবুজ,সাদা হালকা গোলাপী,হালকা বেগুনী রঙ স্ট্রেস কমাতে দারুনভাবে কার্যকরী। এই রঙ গুলো আমরা ব্যবহার করতে পারি ড্রেসের ক্ষেত্রে বা ইনডোর প্ল্যান্ট রাখতে পারি এই কালারের ফুল দিয়ে।
উপসংহার
চলমান জীবনে কাজ এবং কাজের চাপ থাকবেই ,সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে ।কাজের চাপ নিয়ন্ত্রনে রাখার অর্থ কম কাজ করা নয় বরং শরীর ও মনে প্রভাব না ফেলে সেভাবে বেশি কাজ করা। জীবনে অর্জনের চিন্তায় আমরা যেনো বিপদে না পড়ি সে লক্ষ্যে কাজ করা উত্তম। আমরা চাইলেই পরিস্থিতি জটিল করতে পারি আবার চাইলেই তা নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারি। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই “ আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব সোশ্যাল সায়েন্স এর সমীক্ষা অনুসারে ,ভারতে কর্মক্ষেত্রে কাজের অত্যাধিক চাপ সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে প্রায় ৬৫% মানুষ।” ফল স্বরূপ রাতের পর রাত ঘুম নেই, ব্যাহত হচ্ছে ব্যাক্তিগত জীবন ও সংসার। বেশিরভাগ মানুষ বুঝতে পারেন না কিভাবে সামলে উঠবেন এই পরিস্থিতি।
মন্তব্য
মন্তব্যঃ তবুও জীবন, জীবন কখনো থেমে থাকবে না । জীবনের তাগিদেই বেঁচে থাকতে হবে। কাজের চাপ থেকে মুক্তি পেতে উপরে উল্লেখিত বিষয় গুলো অনুস্মরণ করে আমরা আমাদের কাজের চাপ, স্ট্রেস থেকে অনেকখানি মুক্তি পেতে পারি। পরিকল্পিত ওয়ার্ক প্ল্যান,সুষম খাদ্য আর পর্যাপ্ত ঘুম দৈনিক রুটিনে রাখতে হবে। নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিজেরই।