ক্যারিয়ার গঠনে কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব

Spread the love

আজকের যুগে শুধু বই পড়ে ভালো নম্বর পাওয়াই যথেষ্ট নয়। পড়ালেখার পাশাপাশি এমন কিছু শেখা দরকার, যা আমাদের বাস্তব জীবনে কাজ করতে সাহায্য করে। এই শিক্ষাকেই বলে “কর্মমুখী শিক্ষা”। এটি এমন এক ধরনের শিক্ষা, যেখানে হাতে-কলমে কাজ শিখিয়ে মানুষকে দক্ষ করে তোলা হয়। যেমন—ইলেকট্রিশিয়ান কাজ, কম্পিউটার পরিচালনা, গ্রাফিক্স ডিজাইন, গাড়ি মেরামত, ফটোগ্রাফি, সেলাই, হোটেল ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি।

অনেকেই মনে করেন, ভালো ক্যারিয়ারের জন্য শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পেলেই হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অনেক শিক্ষিত তরুণ চাকরি পাচ্ছে না, কারণ তাদের হাতে বাস্তব কোনো কাজের অভিজ্ঞতা নেই। সেখানে যারা কর্মমুখী শিক্ষা নিয়েছে, তারা দ্রুত কাজ শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে। তাই এখনকার সময়ে কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব অনেক বেশি। চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক কর্মমুখী শিক্ষা কি এবং এর গুরুত্ব।

কর্মমুখী শিক্ষা মানে কী?

কর্মমুখী শিক্ষা মানে এমন শিক্ষা, যেখানে শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়, বরং শেখানো হয় কীভাবে হাতে-কলমে কাজ করতে হয়। এটি এমন এক পদ্ধতি, যেখানে ছাত্ররা কাজ করতে করতে শেখে।

 যেমন, একজন ছাত্র যদি হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোর্স করে, তাহলে সে রান্না করা, অতিথি বরণ করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা ইত্যাদি হাতে-কলমে শিখবে। এতে সে শুধু বই পড়ে নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়েই প্রস্তুত হবে।

কেন এই শিক্ষা তগুরুত্বপূর্ণ?

১. চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে

আজকের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে চাকরি পাওয়া খুব সহজ নয়। শুধু বইয়ের জ্ঞান দিয়ে অনেক সময় কাজ পাওয়া সম্ভব হয় না। কর্মমুখী শিক্ষা মানুষকে কাজ শেখায়, হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা দেয়। এর ফলে একজন শিক্ষার্থী বাস্তব কাজের উপযোগী হয়ে ওঠে। তাই চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।

২. আত্মনির্ভর হওয়া যায়  

কর্মমুখী শিক্ষা একজন মানুষকে শুধু চাকরি খোঁজার জন্য নয়, বরং নিজের জন্য কাজ করার সাহসও দেয়। এই শিক্ষার মাধ্যমে কেউ চাইলে নিজের একটি ছোট ব্যবসা শুরু করতে পারে। 

যেমন—একজন দক্ষ দর্জি নিজের টেইলারিং দোকান চালাতে পারে। আবার কেউ ইলেকট্রিক কাজ শিখে ঘরে ঘরে সার্ভিস দিতে পারে। এতে  একদিকে নিজের যেমন  আয় হয় তেমনি অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয় না। ফলে আত্মনির্ভর হওয়া যায়।

৩. পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ বাড়ে 

অনেক সময় শিশুরা শুধু বই পড়ে পড়াশোনা করতে চায় না। তাদের কাছে বইয়ের লেখা অনেক সময় কঠিন বা একঘেয়ে মনে হয়। কিন্তু যদি পড়ার সঙ্গে কাজ শেখার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে তারা আগ্রহ নিয়ে শেখে। হাতে-কলমে কাজ করতে পারলে মজা লাগে, শেখার বিষয়গুলো বাস্তবে দেখা যায়। এতে পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। ফলে শেখা হয় আনন্দের একটি অংশ।

৪. সময় ও অর্থের সাশ্রয়  

কর্মমুখী শিক্ষা সাধারণত কম সময়ে সম্পন্ন করা যায়। এতে চার-পাঁচ বছরের ডিগ্রির প্রয়োজন হয় না, বরং কয়েক মাসের ট্রেনিংই যথেষ্ট হয়। পাশাপাশি খরচও তুলনামূলকভাবে অনেক কম হয়। এতে একজন শিক্ষার্থী দ্রুত কাজ শিখে আয় করতে পারে। দীর্ঘ পড়াশোনার চাপে না গিয়েও ক্যারিয়ার শুরু করা যায়। ফলে সময় ও অর্থ—দুটোই বাঁচে।

৫. বাস্তব জীবনের জন্য প্রস্তুত করে  

কর্মমুখী শিক্ষা মানুষকে বাস্তব জীবনের সমস্যার মোকাবিলা করতে শেখায়। এই শিক্ষা শুধু বইয়ের জ্ঞান নয়, বরং বাস্তবে কাজ করে শেখার সুযোগ দেয়। যেমন—কারিগরি বা ব্যবসায়িক কাজগুলো করে শেখা যায়। এতে আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং দায়িত্ব নিতে শেখা যায়। জীবনের নানা ক্ষেত্রের জন্য তৈরি হওয়া সহজ হয়। ফলে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকা যায়।

বাংলাদেশে কর্মমুখী শিক্ষার প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশে কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। সরকার বিভিন্ন কারিগরি ও ভোকেশনাল প্রতিষ্ঠান চালু করেছে, যেখানে হাতেকলমে কাজ শেখানো হয়। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এ ধরনের শিক্ষা দিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের আগ্রহও এখন এই দিকে বাড়ছে, কারণ এতে দ্রুত চাকরি পাওয়া যায়। তাছাড়া বিদেশে কাজের জন্যও এই শিক্ষাগুলো দরকারি। তাই ক্যারিয়ার গঠনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ হয়ে উঠছে।

একজন তরুণের গল্প

রাশেদ নামের এক তরুণ কলেজ শেষ করে অনেকদিন চাকরি খুঁজেও সফল হতে পারছিল না। পরে সে একটি কম্পিউটার কোর্স করে গ্রাফিক ডিজাইন শেখে। এরপর ছোট ছোট ডিজাইন প্রজেক্ট পেতে থাকে। এখন সে একজন সফল ফ্রিল্যান্সার। রাশেদের মতো আরও হাজারো তরুণ আজ কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে নিজের ক্যারিয়ার গড়ে নিচ্ছে।

কর্মমুখী শিক্ষায় কী কী শিখা যায়?

  • কম্পিউটার পরিচালনা ও সফটওয়্যার শেখা
  • ফ্রিল্যান্সিং ও অনলাইন মার্কেটিং
  • সেলাই ও ফ্যাশন ডিজাইন
  • ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স কাজ
  • কৃষি ও পশুপালন
  • মোবাইল সার্ভিসিং
  • হোটেল ও ট্যুরিজম ব্যবস্থাপনা
  • রন্ধন শিল্প

কর্মমুখী শিক্ষার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

ভবিষ্যতে বাংলাদেশে কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব আরও বাড়বে। চাকরির বাজারে দক্ষতা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা চাহিদা বাড়ছে। তাই আজকের শিশুদের শুধু বইয়ের শিক্ষা নয়, বাস্তবমুখী শিক্ষায়ও দক্ষ করে তুলতে হবে। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন কর্মমুখী কোর্স চালু করতে হবে।

পিতা-মাতা ও শিক্ষকদের করণীয়

পিতা-মাতা ও শিক্ষকদের উচিত শিশুদের ছোটবেলা থেকেই বাস্তব জীবনের দক্ষতা শেখাতে উৎসাহ দেওয়া। শুধু বইয়ের পড়ার ওপর জোর না দিয়ে, কীভাবে একটি কাজ হাতে-কলমে করা যায়, সেটা শেখানো দরকার।

 তারা যেন কোনো কাজকে ছোট না ভাবে এবং ভুল করলে তা থেকে শেখার সুযোগ পায়—এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। পরিবার এবং স্কুল একসঙ্গে কাজ করলে শিশুদের শেখার আগ্রহ অনেক বেড়ে যায়। এতে তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং ভবিষ্যতের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত হয়।

শিক্ষকদের আরও দায়িত্ব হলো ক্লাসে কর্মমুখী শিক্ষার উপযোগী পদ্ধতি ব্যবহার করা। যেমন—প্রজেক্ট, গ্রুপ ওয়ার্ক বা বাস্তব উদাহরণ দিয়ে শেখানো। অন্যদিকে পিতা-মাতাকে শিশুদের শেখার আগ্রহকে সম্মান জানাতে হবে। 

যদি কোনো শিশু ছবি আঁকতে চায়, তাকে আঁকতে দিতে হবে; যদি কাঠের কাজ শিখতে চায়, শেখার সুযোগ দিতে হবে। এভাবে শিশুদের নিজের গুণ ও দক্ষতা বিকাশের সুযোগ দিলে ভবিষ্যতের ক্যারিয়ারে তারা সফল হতে পারবে।

উপসংহার

কর্মমুখী শিক্ষা আমাদের হাতে কাজ করার দক্ষতা দেয়, যা ভবিষ্যতের জন্য খুবই জরুরি। শুধু ডিগ্রি নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা ও কাজের দক্ষতাই একজন মানুষকে সফল করে তোলে। তাই এখনই সময়, আমরা সবাই মিলে কর্মমুখী শিক্ষাকে গুরুত্ব দিই এবং আগামী প্রজন্মকে দক্ষ ও আত্মনির্ভর করে তুলি। ক্যারিয়ার গড়ার এই পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কর্মমুখী শিক্ষাই হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।

Leave a Comment

You cannot copy content of this page