“একজন পিছিয়ে পড়া ছাত্রকে উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়ার সেরা পদ্ধতি”

Spread the love

পড়াশোনায় সব ছাত্র এক নয়। কেউ কেউ অন্যদের থেকে একটু পিছিয়ে পড়ে যেতে পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক কথা, আর এর মানে এই নয় যে তারা কোনো কাজই করতে পারবে না। একজন পিছিয়ে পড়া ছাত্রকেও ভালো করা সম্ভব। শুধু দরকার সঠিক দিকনির্দেশনা, ভালো মনোভাব এবং ধৈর্য্য ধরে চেষ্টা। অনেক সময় ছোট ছোট ভুল বা সমস্যা তার পড়াশোনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। তাই আমরা যদি বুঝতে পারি কোথায় সমস্যা, কিভাবে সাহায্য করতে হয়, তাহলে সে ধীরে ধীরে ভালো হয়ে উঠবে। এই লেখায় আমি এমন কিছু সহজ এবং কার্যকর উপায় শেয়ার করব যা একজন পিছিয়ে পড়া ছাত্রকে উন্নত করতে সাহায্য করবে।

১। পিছিয়ে পড়া ছাত্রের সমস্যাগুলো বুঝে নেওয়া এবং তার মনোভাব গঠন করা

একজন ছাত্র যখন পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ে, তখন তার সমস্যাগুলো ভালোভাবে বোঝা খুবই জরুরি। অনেক সময় ছাত্র নিজেও বুঝতে পারে না কোথায় তার দুর্বলতা, কিংবা সে হতাশ হয়ে পড়ে। এজন্য প্রথমে ছাত্রের সাথে কথা বলে তার সমস্যা, মনোভাব এবং পড়াশোনার অভ্যাস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতে হবে। যেমন, সে কি বিষয়গুলোতে পিছিয়ে? কেন সে পড়াশোনায় আগ্রহ কমায়? তার ঘুম, খাওয়া-দাওয়া ঠিক আছে কি না? এসব বিষয় খুঁজে বের করা দরকার।

ছাত্রের মনোভাব অনেক বড় ভূমিকা রাখে উন্নতির পথে। যদি সে নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে বা মনে করে সে পারবে না, তাহলে কোনো উন্নতি আসা কঠিন। তাই প্রথমে তাকে উৎসাহ দিতে হবে, ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে তার আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। এতে সে বুঝতে পারবে যে পিছিয়ে পড়া মানেই শেষ নয়, সামনের পথটা খোলা আছে।

ছাত্রের চারপাশের পরিবেশও গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের সমর্থন, শিক্ষক ও বন্ধুদের সাহায্য তাকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। একা কেউ অনেক দূর যেতে পারে না, তাই ভালো সমর্থন থাকলে ছাত্রের উন্নতির সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।

আসলে, একজন পিছিয়ে পড়া ছাত্রকে উন্নতির জন্য প্রথম শর্ত হল তার সমস্যা এবং দুর্বলতাগুলো স্পষ্টভাবে জানা এবং তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করা। এই ভিত্তি তৈরি হলে পরের ধাপে আমরা কিভাবে কার্যকর পরিকল্পনা ও পদ্ধতি নিতে পারি তা আলোচনা করবো।

২। লক্ষ্য নির্ধারণ এবং ছোট ছোট পরিকল্পনা করা

একজন পিছিয়ে পড়া ছাত্রকে উন্নত করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো স্পষ্ট এবং বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ করা। যখন লক্ষ্য ঠিকঠাক না থাকে, তখন মনোযোগ ছড়িয়ে যায়, যা হতাশার কারণ হয়। তাই প্রথমেই ছোট ছোট, সহজ এবং অর্জনযোগ্য লক্ষ্য তৈরি করা জরুরি।

ছাত্রের সাথে বসে দেখা উচিত সে কোন বিষয়ে কতটুকু উন্নতি করতে চায়, এবং কী সময়ের মধ্যে করতে চায়। উদাহরণস্বরূপ, “আগামী এক মাসে ইংরেজি ব্যাকরণের ৫টি অধ্যায় ভালোভাবে বুঝে নেবে” বা “প্রতিদিন অর্ধেক ঘণ্টা পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলবে” — এমন ছোট লক্ষ্য ছাত্রের জন্য বোঝা সহজ এবং তারা এগুলো পূরণ করতে পারলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে।

ছোট লক্ষ্য পূরণের পর ধীরে ধীরে বড় লক্ষ্যগুলো নির্ধারণ করা যেতে পারে। এতে ছাত্রের মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় থাকে এবং সে পড়াশোনায় আগ্রহ হারায় না। লক্ষ্য ছাড়াও একটা রুটিন বা সময়সূচী তৈরি করা খুবই কাজে লাগে। পড়াশোনার জন্য নির্দিষ্ট সময় রাখা, এবং সেই সময়ে অন্য কাজে ব্যস্ত না থাকা মানে পড়াশোনার মান বাড়ানো।

একটা কথা মনে রাখতে হবে, পরিকল্পনা গুলো খুব কঠোর বা জোরপূর্বক হওয়া উচিত নয়। ছাত্রের বয়স, শিখনের গতি এবং আগ্রহ অনুযায়ী পরিকল্পনা সাজানো দরকার। কখনো কখনো একটু বিশ্রাম বা মজা করাও জরুরি, যাতে সে চাপমুক্ত থাকে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করলে ছাত্র ধীরে ধীরে তার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে এবং নতুন কিছু শেখার প্রতি উৎসাহী হয়। এই ধাপে ধৈর্য্য ধরে ছাত্রকে সহায়তা করতে হবে এবং তার অগ্রগতি নিয়ে খুশি হতে হবে। ছোট ছোট সাফল্য তাকে বড় সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে।

৩। শেখার পদ্ধতি ও অভ্যাস গঠন

একজন পিছিয়ে পড়া ছাত্রকে উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য শেখার সঠিক পদ্ধতি ও অভ্যাস গঠন অপরিহার্য। অনেক সময় ছাত্রেরা পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে কারণ তারা ভুলভাবে পড়ে বা তাদের শেখার পদ্ধতি উপযুক্ত নয়। তাই ভালো শেখার জন্য কিছু সহজ ও কার্যকরী পদ্ধতি জানানো দরকার।

প্রথমে, ছাত্রকে শেখার সময় ছোট ছোট বিরতি নিতে উৎসাহিত করা উচিত। একটানা অনেকক্ষণ পড়লে মন একঘেয়ে হয়ে যায় এবং মনোযোগ কমে। ২৫ থেকে ৩০ মিনিট পড়ার পর ৫ থেকে ১০ মিনিট বিশ্রাম নিলে মন সতেজ থাকে এবং শেখার গতি বাড়ে।

দ্বিতীয়ত, পড়া বিষয়গুলোকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে শেখার পরামর্শ দেওয়া ভালো। এতে ছাত্র সহজেই বিষয়গুলো বুঝতে পারে এবং তথ্য মস্তিষ্কে দীর্ঘস্থায়ী হয়। উদাহরণস্বরূপ, একদিন পুরো অধ্যায় না পড়ে সেটাকে ভাগ ভাগ করে পড়লে আরও ভালো শেখা হয়।

তৃতীয়ত, শেখার সময় নোট গ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছোট ছোট টীকা বা মূল বিষয়গুলো লিখে নিলে পরে দ্রুত রিভিউ করা যায় এবং বিষয়গুলো স্মরণ থাকে। নোট নিতে গিয়ে ছাত্রের মনোযোগ বেড়ে যায়, তাই এটি খুব কার্যকরী অভ্যাস।

চতুর্থত, শিক্ষকের বা বড়দের সাহায্য নিতে উৎসাহিত করতে হবে। কোন বিষয় বুঝতে সমস্যা হলে তা একা লুকিয়ে না রেখে কাউকে জিজ্ঞাসা করা উচিত। এটা শেখার অংশ এবং বুঝতে না পারলে প্রশ্ন করা খুবই ভালো অভ্যাস।

সবশেষে, নিয়মিত নিজেকে পরীক্ষা করার অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। নিজেকে প্রশ্ন করে বা ছোট ছোট টেস্ট নিলে ছাত্র তার দুর্বল দিক বুঝতে পারে এবং সেগুলো ঠিক করতে পারে।

এই পদ্ধতিগুলো মেনে চললে একজন পিছিয়ে পড়া ছাত্র ধীরে ধীরে উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে এবং পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ও মনোযোগ বাড়ে।

৪। মনোযোগ এবং সময় ব্যবস্থাপনা শিখানো

একজন পিছিয়ে পড়া ছাত্রের উন্নতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মনোযোগ ধরে রাখা এবং সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করা। পড়াশোনা করার সময় মনোযোগ হারানো বা সময় নষ্ট করা খুব সাধারণ সমস্যা। তাই সময় ব্যবস্থাপনা শেখানো খুবই জরুরি।

প্রথমে ছাত্রকে শেখাতে হবে কিভাবে নিজের কাজের জন্য নির্দিষ্ট সময় ঠিক করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিদিন বিকেলের একটা সময় নির্দিষ্ট করে রাখা পড়াশোনার জন্য, আর সেই সময়ে মোবাইল বা টিভির মতো অন্যান্য বিভ্রান্তিকর জিনিসগুলো থেকে দূরে থাকা। এই ছোট ছোট নিয়ম পালন করলে মনোযোগ বাড়ে এবং পড়াশোনার মান উন্নত হয়।

দ্বিতীয়ত, ছাত্রকে ‘প্রায়োরিটি’ বা গুরুত্ব অনুযায়ী কাজ করার অভ্যাস গড়ে দিতে হবে। অর্থাৎ সবচেয়ে জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আগে শেষ করার চেষ্টা করা। এতে পড়াশোনার চাপ কমে এবং সে সময়ের ভালো ব্যবহার করতে পারে।

তৃতীয়ত, পড়াশোনার সময় ছোট ছোট বিরতি নেয়ার পদ্ধতি মেনে চলতে হবে। দীর্ঘ সময় একসঙ্গে পড়াশোনা করলে মনোযোগ কমে যায়। তাই ২৫ থেকে ৩০ মিনিট পড়ার পর ৫ থেকে ১০ মিনিট বিশ্রাম নিলে আবার নতুন উদ্যমে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া যায়।

এছাড়া, ছাত্রের দৈনন্দিন সময় সূচি তৈরি করে সেটা অনুসরণ করতে উৎসাহিত করতে হবে। ঠিক সময়ে ঘুমানো, খাওয়া, পড়াশোনা ও খেলার ভারসাম্য বজায় রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। ভালো শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য এটা অপরিহার্য।

সব মিলিয়ে, ভালো সময় ব্যবস্থাপনা এবং মনোযোগ ধরে রাখার অভ্যাস গড়ে তোলা একজন পিছিয়ে পড়া ছাত্রকে সঠিক পথে নিয়ে যায় এবং তার পড়াশোনায় উন্নতি নিশ্চিত করে।

৫। ধৈর্য্য ও ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলা

একজন পিছিয়ে পড়া ছাত্রকে উন্নত করার ক্ষেত্রে ধৈর্য্য এবং ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো পরিবর্তন বা উন্নতি সময়সাপেক্ষ এবং একটু ধৈর্যের দরকার হয়। তাই ছাত্রকে শেখাতে হবে যে, দ্রুত ফলাফল না পেলেও হতাশ হওয়ার কিছু নেই।

ধৈর্য্য ধরে নিয়মিত চেষ্টা করলে ধীরে ধীরে উন্নতি আসবেই। এই সময় তাকে ছোট ছোট সাফল্য উদযাপন করতে উৎসাহিত করতে হবে, যেমন পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া বা নতুন কোনো বিষয় বুঝে ফেলা। ছোট সাফল্যগুলো তাকে আরও আগ্রহী ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।

একই সঙ্গে, ছাত্রের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলা দরকার। সে যেন নিজেকে এবং নিজের ক্ষমতাকে বিশ্বাস করে। “আমি পারব” এই মনোভাব থাকলেই যে কোনো বাধা অতিক্রম করা সম্ভব। পরিবারের সদস্য, শিক্ষক ও বন্ধুদেরও উচিত তাকে এই ইতিবাচক শক্তি দেওয়া এবং ভুলে ভয় পাওয়া থেকে রক্ষা করা।

ছাত্রের অবস্থা বুঝে তাকে অনুপ্রেরণা দিতে হবে, যাতে সে পড়াশোনাকে দুশ্চিন্তা নয়, বরং মজার ও শেখার এক আনন্দময় কাজ হিসেবে দেখতে পারে। এর ফলে সে আত্মসম্মান বাড়িয়ে নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলতে পারে।

সব মিলিয়ে, ধৈর্য্য, ধারাবাহিকতা ও ইতিবাচক মনোভাব ছাড়া একজন পিছিয়ে পড়া ছাত্রের উন্নতি সম্ভব নয়। এই গুণগুলো তাকে শুধু পড়াশোনায় নয়, জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে সফলতায় পৌঁছাতে সাহায্য করবে।

উপসংহার

একজন পিছিয়ে পড়া ছাত্রের উন্নতি কোনো একদিনেই হয় না, তবে সঠিক পরিকল্পনা, ভালো অভ্যাস এবং ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে ধৈর্য ধরে চেষ্টা করলে সে অবশ্যই সফল হবে। সমস্যা বুঝে তাকে সঠিক দিক দেখানো, ছোট ছোট লক্ষ্য রাখা এবং নিয়মিত সাহায্য করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পড়াশোনা শুধু বই পড়া নয়, নিজের ওপর বিশ্বাস করা ও চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার নাম। তাই, যদি আমরা পাশে থেকে ভালোবাসা ও সহযোগিতা দিয়ে তাকে উৎসাহিত করি, তাহলে সে নিজেই তার জীবনে এক নতুন শুরু করতে পারবে এবং অনেক ভালো করে উঠবে। মনে রাখবেন, প্রত্যেক ছাত্রের মধ্যে কিছু না কিছু সম্ভাবনা থাকে, শুধু তাকে বের করে আনতে হবে।

Leave a Comment

You cannot copy content of this page