পড়াশোনায় সফল হতে পড়া মনে রাখার সবচেয়ে কার্যকর টেকনিক

Spread the love

পড়া মনে রাখা অনেকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ি, তবুও পরীক্ষার সময় সবকিছু মনে থাকে না। এতে হতাশা আসে, আত্মবিশ্বাস কমে যায়। তবে সত্যি কথা হলো, পড়াশোনার সঠিক পদ্ধতি মেনে চললেই আমরা সহজেই যা পড়ি তা স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারি। এই নিবন্ধে আমরা এমন সহজ ও কার্যকর টেকনিক নিয়ে আলোচনা করব, যেগুলো আপনাকে পড়া মনে রাখতে সাহায্য করবে। যেকেউ, এমনকি ছোট ছেলেমেয়েরাও সহজে বুঝতে পারবে এই টেকনিকগুলো এবং প্রয়োগ করতে পারবে।

১। কেন পড়া মনে রাখা কঠিন হয়? — পড়াশোনার মস্তিষ্কের রহস্য

পড়া মনে রাখা অনেকের জন্য কঠিন একটি কাজ। কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ার পরেও আমরা বিস্মৃতির কাছে হার মানি। কেন এমন হয়? আসলে, আমাদের মস্তিষ্কে তথ্য আসার পর সেটা ঠিকভাবে জমা না হলে বা সঠিক সময় না দিলে আমরা সহজে ভুলে যাই।

আমাদের মস্তিষ্ক তিনটি প্রধান অংশে কাজ করে — তথ্য নেয়, প্রক্রিয়া করে এবং মনে রাখে। কিন্তু যদি তথ্য একবারেই বেশি মাত্রায় আসে, তখন মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে যায়। যেমন, খুব বেশি বই বা বিষয় একসাথে পড়লে আমাদের মন এক জায়গায় ধরে রাখতে পারে না।

আরেকটি কারণ হলো মনোযোগের অভাব। যদি পড়ার সময় মন অন্য কোথাও থাকে, তাহলে তথ্য ঠিকমতো মস্তিষ্কে ঢোকে না। এতে মনে রাখা কঠিন হয়ে যায়।

তাছাড়া, সময় ও পরিবেশও গুরুত্বপূর্ণ। সকালে পড়া মানসিক সতেজতায় সাহায্য করে, রাতে অনেক সময় মস্তিষ্ক ক্লান্ত থাকে। তাই সঠিক সময় বেছে নিয়ে পড়া খুব দরকার।

একটা ছোট উদাহরণ দিই — আপনি যদি সকাল বেলা ভালো করে পড়েন, একটু বিরতি নিয়ে আবার বিকেলে একটু পড়েন, তাহলে মস্তিষ্ক তথ্যগুলো ভালভাবে ধরে রাখতে পারে। কিন্তু একবারে রাতভর পড়া মানে অনেক তথ্য জমে যায় আর মনগড়া হয়ে যায়।

সুতরাং, পড়া মনে রাখার জন্য আমাদের মস্তিষ্কের কাজ, মনোযোগ এবং সময়ের গুরুত্ব বুঝতে হবে। এই জ্ঞান থেকে আমরা সহজেই পড়াশোনার জন্য ভালো টেকনিক তৈরি করতে পারি।

২। পড়া মনে রাখার জন্য সঠিক সময় ও পরিবেশের গুরুত্ব

আপনি যদি পড়া মনে রাখতে চান, তাহলে সঠিক সময় বেছে নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মস্তিষ্ক দিনের বিভিন্ন সময়ে ভিন্নভাবে কাজ করে। সকালে মস্তিষ্ক বেশ সতেজ থাকে, মনোযোগ বেশি থাকে, তাই নতুন কিছু শেখার জন্য সকালটাই সবচেয়ে ভালো সময়।

অনেকেই হয়তো রাতের শান্ত সময়কে কাজে লাগাতে চান, কিন্তু রাতের শেষে মস্তিষ্ক অনেক সময় ক্লান্ত থাকে। তখন তথ্য গুলো মনে রাখার পরিবর্তে ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই দিনের মধ্যে যেখানে মন ভাল থাকে, সেই সময় পড়াই বেশি ফলপ্রসূ।

পড়ার জন্য একটি শান্ত ও নিরিবিলি পরিবেশ প্রয়োজন। যদি চারপাশে অনেক শব্দ-শোর থাকে, অথবা টেলিভিশন, মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপন বা বন্ধুরা ডাকে, তাহলে মন অন্যত্র বিভ্রান্ত হয়। একদম নিরিবিলি পরিবেশে পড়া হলে মন পড়ায় বেশি ধরে এবং সহজে তথ্য মনে রাখা যায়।

পড়ার জায়গা যেন সবসময় সুষ্ঠু ও পরিষ্কার হয়, এতে পড়তে মন যায়। আর জায়গাটি যেন আলো-আঁধারার সমন্বয়ে হয়, খুব বেশি ঝলমলে আলো বা খুব অন্ধকার জায়গা পড়াশোনার জন্য ভালো নয়।

একটা কথোপকথনের মতো বলি — ভাবুন, আপনি সকালে একদম শান্ত এক জায়গায় বসে পড়ছেন, তখন আপনার মন খুব ভালো থাকে, মনোযোগও থাকে। কিন্তু যদি পড়ার সময় কেউ কথা বলে বা বাইরে শব্দ আসে, তখন মন বিহ্বল হয়ে যায়, পড়া মনে থাকে না।

সুতরাং, পড়ার সঠিক সময় বেছে নেওয়া আর সঠিক পরিবেশ তৈরি করা হলো পড়া মনে রাখার সহজ কিন্তু শক্তিশালী টেকনিক।

৩। পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ানোর সহজ কৌশল

পড়াশোনায় মনোযোগ খুব জরুরি। মনোযোগ না থাকলে পড়া মনে রাখা মুশকিল হয়ে যায়। তাই পড়ার সময় মনোযোগ বাড়ানোর জন্য কিছু সহজ টেকনিক জানা দরকার।

প্রথমত, পড়ার আগে নিজেকে বলুন, “আমি এখন পড়ার সময়”। এটি আপনার মস্তিষ্ককে সংকেত দেয় যে, এখন মনোযোগ দিতে হবে। এটি ছোট্ট একটা ট্রিক, কিন্তু খুব কার্যকর।

দ্বিতীয়ত, পড়ার সময় মোবাইল ফোন, টিভি বা অন্য কোনো ডিভাইস বন্ধ রাখুন বা আলাদা জায়গায় রাখুন। এগুলো মনোযোগ সরিয়ে নেয়। যখন পড়বেন, তখন পরিবেশ যেন শান্ত থাকে।

তৃতীয়ত, পড়ার সময় মাঝে মাঝে ছোট বিরতি নিন। অনেকক্ষণ একটানা পড়া মনোযোগ কমিয়ে দেয়। ২৫-৩০ মিনিট পড়ার পর ৫ মিনিট বিরতি নিন। এই পদ্ধতিটাকে বলা হয় ‘পোমোডোরো টেকনিক’। এতে মন সতেজ থাকে এবং পড়া ভালোভাবে মনে থাকে।

চতুর্থত, পড়ার সময় একসাথে অনেক বই বা বিষয় না নিয়ে ছোট ছোট অংশে পড়ুন। এতে মন ভালোভাবে ধরে এবং তথ্য মনে রাখতে সহজ হয়।

একটি কথোপকথন শোনান — ভাবুন, আপনার মন যদি একদম বিভ্রান্ত থাকে, আপনি কি ভালো করে কিছু মনে রাখতে পারবেন? না। তাই মনোযোগ বাড়ানোই পড়া মনে রাখার প্রথম ধাপ।

এই সহজ কৌশলগুলো মেনে চললে আপনার পড়ার দক্ষতা বাড়বে এবং তথ্য মনে রাখা সহজ হবে।

৪। পড়া মনে রাখার জন্য রিভিশনের গুরুত্ব ও সঠিক পদ্ধতি

পড়ার সময় শুধু একবার পড়লেই চলবে না, রিভিশন বা পুনরাবৃত্তি করতে হবে। রিভিশন হলো পূর্বে পড়া বিষয়গুলো আবার পড়া, যাতে সেটা মস্তিষ্কে স্থায়ী হয়।

মস্তিষ্ক তথ্যকে দুই ভাগে ভাগ করে রাখে — সংক্ষিপ্ত মেয়াদী স্মৃতি এবং দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতি। যখন আপনি বারবার রিভিশন করেন, তখন তথ্য দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতিতে চলে যায়। তাই রিভিশন না করলে তথ্য খুব সহজে ভুলে যান।

সঠিক রিভিশনের জন্য কয়েকটি নিয়ম মেনে চলতে হবে। প্রথমত, পড়ার পরে প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একটি বার রিভিশন করা উচিত। তারপর ৩ দিন, ৭ দিন এবং ১৫ দিনের মধ্যে একেকবার রিভিশন করুন। এতে তথ্য মস্তিষ্কে ভালোভাবে জমে থাকে।

রিভিশন করার সময় শুধু পড়া না, বিষয় বুঝে নিন। বিষয় বুঝলে মনে রাখা অনেক সহজ হয়। প্রয়োজনে ছোট্ট নোট বানিয়ে নিন, যা দ্রুত দেখতে পারবেন।

একটি সহজ কথোপকথন — ভাবুন, আপনি নতুন গান শুনেছেন। যদি বারবার গানটি শুনেন, তখন আপনি গানের কথা ভুলবেন না। পড়াশোনাও ঠিক তাই। বারবার পড়লেই মনে থাকে।

তাই রিভিশনকে পড়ার অংশ হিসেবে নিন। নিয়মিত রিভিশন করলে পড়া অনেক সহজে মনে থাকবে এবং পরীক্ষায় ভালো ফল পাবেন।

৫। স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর আরও কিছু সহজ টেকনিক

পড়া মনে রাখার জন্য স্মৃতিশক্তি বাড়ানো খুব দরকার। স্মৃতিশক্তি ভাল হলে আমরা সহজে তথ্য মনে রাখতে পারি। নিচে কিছু সহজ ও কার্যকর টেকনিক দিলাম যা স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।

প্রথমত, নিয়মিত ব্যায়াম করুন। শরীর সুস্থ থাকলে মস্তিষ্কও ভালো কাজ করে। হাঁটা, দৌড়ানো, যোগব্যায়াম সবই মস্তিষ্কের জন্য উপকারী।

দ্বিতীয়ত, পর্যাপ্ত ঘুম নিন। রাতে কম ঘুম হলে মস্তিষ্ক ঠিকভাবে বিশ্রাম পায় না। এর ফলে স্মৃতি কমজোরি হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম জরুরি।

তৃতীয়ত, ভালো খাওয়া দাওয়া করুন। ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার যেমন ফল, সবজি, বাদাম মস্তিষ্ককে শক্তিশালী করে।

চতুর্থত, তথ্যগুলোকে ছবি বা গল্পের সঙ্গে যুক্ত করুন। যখন আমরা কোনো গল্প মনে করি বা ছবি মনে করি, তখন সেটি বেশি সহজে স্মৃতিতে থাকে। যেমন ইংরেজি শব্দ শিখলে সেই শব্দ দিয়ে একটা ছোট গল্প তৈরি করতে পারেন।

পঞ্চমত, পড়ার সময় হালকা গান শুনুন, কিন্তু খুব বেশি জোরে নয়। কিছু ক্ষেত্রে এটি মন শান্ত রাখতে সাহায্য করে।

সবশেষে, ধৈর্য ধরুন। স্মৃতিশক্তি বাড়ানো সময় নেয়। নিয়মিত অনুশীলন করলে আপনি নিজেই দেখবেন পড়া অনেক ভালো মনে থাকবে।

উপসংহার

পড়া মনে রাখার জন্য শুধু পড়া নয়, সঠিক পদ্ধতি এবং নিয়মিত অনুশীলন প্রয়োজন। সঠিক সময় ও পরিবেশে পড়া, মনোযোগ বাড়ানো, নিয়মিত রিভিশন করা এবং স্মৃতিশক্তি উন্নয়নের টেকনিকগুলো মেনে চললে আপনি অবশ্যই পড়া সহজে মনে রাখতে পারবেন। ধৈর্য্য ধরে এই কৌশলগুলো প্রয়োগ করুন, সময়ের সঙ্গে ফলাফল দেখতে পাবেন। স্মৃতি ভালো রাখার মাধ্যমে পড়াশোনায় সাফল্য অর্জন অনেক সহজ হয়ে যাবে।

Leave a Comment

You cannot copy content of this page