পৃথিবীর সুখটা স্থায়ী না। সুখের পরে দুঃখ আসে, আবার দুঃখের পরে সুখ আসে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম, এটাই জীবনের নিয়ম। ভালো-মন্দ, হাসি কান্না, সুখ-দুঃখ এসব কিছুর সমন্বয়ে জীবন। মন্দ আর কান্না এবং দুঃখ আছে বলেই আমরা সুখের জন্য মরিয়া হয়ে থাকি। জীবনে অন্তত একবার কঠিন সময় কিংবা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় নাই এমন মানুষ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া বিরল। আর যে কোন খারাপ সময় বা পরিস্থিতি অতিক্রম এবং উত্তরণের ক্ষমতা জেনেটিক ভাবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রয়েছে। আর যদি তা না হত তাহলে,অনেক আগেই পৃথিবীর অস্তিত্ব এবং সভ্যতা বিলীন হয়ে যেত। জীবনে যেমন ছোট ছোট বিষয় আসে, ঠিক তেমনি একসময় চলেও যায়। তাই অতিরিক্ত চিন্তা বা উত্তেজিত না হয়ে,শান্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে।
প্রতিকার এবং আমাদের করণীয়
আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি ঘটনার সময় আমরা চাপ অনুভব করি। এই চাপের ফলে অস্থিরতা,দুশ্চিন্তা, বিভ্রান্ত ও বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ি আমরা। গবেষক এবং মনোবিজ্ঞানীদের মতে প্রতিক্রিয়া দেখানো আমাদের স্বভাব বা আচরণের বহিঃপ্রকাশ। এবং এই আচরণের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে ব্যক্তিত্ব, নৈতিকত্ব, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং পারিবারিক শিক্ষা সব কিছুই প্রকাশ পায়। আমাদের অনেকেরই একটি বাজে অভ্যাস আছে সেটি হল অন্যের উপর রাগ প্রদর্শন করা। রাগ একটি সহজাত আবেগ। এই রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের অবশ্যই কৌশলী হতে হবে।
আমাদের স্বাভাবিক আচরণ গুলোর একটি হচ্ছে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করা। আপনার মন মানসিকতা এবং ব্যক্তিত্ব কতটা সতেজ এবং প্রাণবন্ত তার উপর নির্ভর করে কোন পরিস্থিতিতে আমরা কি ধরনের আচরণ করব। হঠাৎ এমন কিছু শুনতে পেলেন আপনি, যেটা শোনার পর আপনার মাথাটা অনেক গরম হয়ে গেল আপনি রাগে গজগজ করতে লাগলেন, অথবা এমন কিছু শুনলেন যেটা শোনার পর দুঃখ গ্লানিতে আপনি বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে আপনি কি করবেন? কিভাবে নিজেকে শান্ত রাখবেন?
প্রথম কাজ হচ্ছে, যে কোন ঘটনায় আপনি সঙ্গে সঙ্গে কোন প্রকার প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। অবশ্যই নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে সব সময় স্থিরভাবে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করা। কঠিন পরিস্থিতির সময় যতই আমরা ঘটনা নিয়ে ভাববো এবং এই কঠিন পরিস্থিতির কারণ উদ্ঘাটনের জন্য মনকে ব্যস্ত রাখবো ততই আমাদের শান্ত থাকার সম্ভাবনা কমে যায়। পরিস্থিতি নিয়ে এটা অথবা ওটা হলে কেমন হতো এমন চিন্তায় জড়াবেন না।
আপনার পরিস্থিতি যেমন ই হোক না কেন সব সময় আপনার মনকে ইতিবাচকভাবে স্থির রাখার চেষ্টা করুন। এবং সব সময় ই নেতিবাচক সকল দিক এবং কথা থেকে মনকে দূরে রাখার চেষ্টা করুন। চেষ্টা করবেন যে কোন কঠিন পরিস্থিতি থেকে নিজেকে দূরে রাখার। আপনি আপনার কাজ নিয়ে যদি ডিপ্রেশনে ভোগেন, তাহলে ১-২ ঘন্টা কাজের জায়গা থেকে ব্রেক নিতে পারেন। ফোনের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে, ফোনটি সাইলেন্ট মুডে রেখে কিছুটা সময় নিজের মতো করে কাটাতে পারেন।
নিজের ভাবনা গুলোকে প্রাধান্য দিন। কঠিন পরিস্থিতিতে সব সময় পজিটিভ থাকার চেষ্টা করুন। নিজের সকল চ্যালেঞ্জ এবং নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্ভাবনের লক্ষে এই পদ্ধতি দারুন কার্যকর। কঠিন পরিস্থিতিতে নিজেকে শান্ত রাখার জন্য আপনি খানিকটা দৌড়ে অথবা হাঁটাহাঁটি করে আসুন। যাতে করে আপনার শারীরিক পরিশ্রম হয়। দৌড়ানো অথবা হাঁটাহাঁটি করার ফলে আপনার শরীরে এন্ডরফিনস, ডোপামিন, অক্সিটোসিন, এড্রেনালিন এমন সব ‘গুড ফিল’ হরমোন নিঃসৃত হয়। তাতে আপনার অনেকটা ভালো লাগবে।
জেনে নিন আরো কয়েকটি কার্যকর টিপস
১. নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেওয়া থেকে বিরত থাকুন
যেকোনো কঠিন মুহূর্তে পরিস্থিতি আরো খারাপ করে তোলার জন্য নেতিবাচক প্রক্রিয়ার যথেষ্ট ভূমিকা থাকে। তাই কঠিন পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়া দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। সম্ভব হলে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেওয়ার চেষ্টা করুন। জোরে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে হবে এবং শান্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে।
২. কাছের বন্ধুকে ফোন করুন
কথায় আছে বিপদের বন্ধুই আসল বন্ধু। একজন প্রকৃত বন্ধুই পারে কঠিন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের জন্য সাহায্য করতে। তাই কঠিন পরিস্থিতিতে আপনি আপনার কাছের বন্ধুর সাথে দেখা করুন তা না করতে পারলে, অন্তত ফোন করে কথা বলতে পারেন, নিজের সমস্যার কথা জানাতে পারেন এবং তার কাছে পরামর্শ নিতে পারেন। কঠিন পরিস্থিতিতে অনেক সময় আমরা সমাধানে আসতে পারি না তাই তখন নিজেকে বাদ দিয়ে কাছের কোন বন্ধুর কাছ থেকে তার দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন সমাধান সূত্র বের হয়ে আসতে পারে। তাই আপনি আপনার বন্ধুর সাথে মুক্ত মনে নিজের কঠিন পরিস্থিতি কিংবা সমস্যার কথা অথবা আপনার চিন্তাভাবনাগুলো শেয়ার করতে পারেন।
৩. ব্যর্থতা মেনে নেওয়া
সফলতা যেমন জীবনের একটি অংশ ঠিক তেমনি ব্যর্থতাও জীবনের অংশ। ব্যর্থতা মেনে নেওয়ার ক্ষমতা এবং মন মানসিকতা তৈরি করতে হবে। পরাজয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সফলতা অর্জন করতে হবে। ব্যর্থতাকে মনে করতে হবে সফলতার একটি ধাপ।
৪. ধ্যান করা
কঠিন মুহূর্ত কিংবা পরিস্থিতিতে, সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য মনকে শান্ত রাখতে হয়। মনকে শান্ত রাখার একটি বিশেষ কৌশল হল ধ্যান করা। এছাড়া প্রকৃতির কাছে যাওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, ইত্যাদি আমাদের মনকে শান্ত রাখতে সাহায্য করে।
৫. এমন একজনকে খুঁজে নিন যে এরূপ অবস্থার মোকাবেলা করেছে
এমন একজনকে খুঁজে নিন যে আপনার মত এরূপ কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন এবং তা মোকাবেলা করেছেন। যেমন: কোন সফল ব্যক্তির জীবনী থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারেন। এর জন্য বিভিন্ন বরেণ্য মনীষীদের জীবনীগ্রন্থ পড়তে পারেন এবং অনুপ্রেরণা মূলক যে কোন কিছু গ্রহণ করতে পারেন,যেমন: মোটিভেশনাল অডিও,ভিডিও অথবা বই ইত্যাদি।
৬. প্রেম-ভালবাসা, ব্রেকআপ, ডিভোর্স
প্রেম- ভালোবাসা, ব্রেকআপ, ডিভোর্স ইত্যাদি এই বিষয়গুলো যদি হয়ে থাকে আপনার জন্য ‘কঠিন পরিস্থিতি’ তবে আমি আপনাকে বলতে চাই এসব কিছুই সাধারণ ব্যাপার। আমাদের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে গোটা মহাবিশ্বের প্রক্রিয়া। আপনার কিংবা আমার ইচ্ছায় এ প্রক্রিয়া তার গতি বদলাবে না। তাই কোন কিছুতে ওভার রিয়েক্ট না করে, বিপরীত পাশের মানুষের সাথে কথা বলুন। কথা বলে সমাধান করার চেষ্টা করুন। যেকোনো সমস্যায় একে অপরের সাথে কথা বলে, ৮০% থেকে ১০০%পর্যন্ত সমাধান করা যায়। অথবা এমন একজন তৃতীয় পক্ষ খুঁজুন, যে আপনাদের দুজনেরই পরিচিত এবং আস্থাভাজন, এবং তার মাধ্যমে আপনারা দুজন সমাধানে আসার চেষ্টা করুন।
৭. রিলাক্স করুন
হতাশা, ক্লান্তি, উদ্বেগ, মানসিক চাপ ও ঘুমের অভাবে মানুষের জীবনে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। আপনি যদি অনেক সময় যাবত হতাশা বা মানসিক চাপে থাকেন তাহলে আপনার শারীরিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক স্বাস্থ্য উভয়েরই ক্ষতি হতে পারে। এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য খুব বিশেষ কিছু করার প্রয়োজন নেই। আপনি নিজে যা করতে পছন্দ করেন, তাই করুন। টিভি দেখুন,গান শুনুন, বই পড়ুন, সিনেমা দেখুন, প্রিয় খেলা খেলুন,ছবি আকুন, প্রিয় কোন জায়গায় ঘুরে আসতে পারেন, অল্প হাঁটাহাঁটি করতে পারেন, কিংবা জিমে গিয়ে ওয়ার্কআউট করে আসতে পারেন, ধর্মগ্রন্থ চর্চা করতে পারেন ইত্যাদি। মোটকথা এমন কিছু করুন, যাতে আপনি টেনশন থেকে দূরে থাকতে পারেন, এবং আপনার মানসিক চাপ কমে যায়। তাহলে দেখবেন আপনার মন কে সতেজ করতে সক্ষম হয়েছেন। এতে করে আপনি স্থির ভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবেন।
উপসংহার
যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে শান্ত থাকা একদিনের অভ্যাসে বা হুট করে তৈরি হবে না। নিয়মিত অল্প কিছু সময়ের জন্য হলেও হাটাহাটি করা, নিয়মিতভাবে প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম করা, পরিমাণ মতো পানি পান করা, সময় মতো এবং পরিমাণ মতো ঘুমানো। এবং যোগ ব্যায়াম করার মাধ্যমে মনে প্রশান্তির অনুভব আনুন।