প্লাস্টিক দূষণ কি
প্লাস্টিক দূষণ হল পরিবেশ কর্তৃক প্লাস্টিক পদার্থের আহরণ যা পরবর্তীতে যে বন্যপ্রাণ, বন্যপ্রাণ আবাসস্থল, এমনকি মানবজাতীর ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে৷ আকারের উপর ভিত্তি করে, মাইক্রো-, মেসো-, অথবা ম্যাক্রোবর্জ্য এই তিনভাগে প্লাস্টিক দূষণকে শ্রেণীকরণ করা হয়। নিয়মিত প্লাস্টিক পদার্থের ব্যবহার “প্লাস্টিক দূষণে ” মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। পলিথিন ব্যাগ, কসমেটিক প্লাস্টিক, গৃহস্থালির প্লাস্টিক, বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের বেশিরভাগই পুনঃচক্রায়ন হয় না। এগুলো পরিবেশে থেকে বর্জ্যের আকার নেয়৷ মানুষের অসচেতনতাই “প্লাস্টিক দূষণের ” প্রধান কারণ। প্লাস্টিক এমন এক রাসায়নিক পদার্থ যা পরিবেশে বিয়োজন অথবা কারখানায় পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করতে প্রচুর সময় লাগে। তাই একে “অবিয়োজনযোগ্য পদার্থ” হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। তাই প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে।
প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রকারভেদ
সাধারণত “প্লাস্টিক দূষণে “ জন্য দুই ধরনের প্লাস্টিক দায়ী: 1. মাইক্রোপ্লাস্টিক (ক্ষুদ্রপ্লাস্টিক) যা সাধারণত মেগা বা বৃহৎ হিসেবে পরিগণিত এবং 2. ম্যাক্রো-প্লাস্টিক। উত্তর গোলার্ধে শহুরে কেন্দ্র ও জল সম্মুখভাগে মেগা ও মাইক্রোপ্লাস্টিক সর্বোচ্চ ঘনত্বের মধ্যে প্রায় ঘনীভূত অবস্থায় সঞ্চিত রয়েছে।
প্লাস্টিক বর্জ্য প্রাথমিক বা মাধ্যমিক হিসাবেও শ্রেণীকরণ করা হয়ে থাকে। প্রাথমিক প্লাস্টিক সংগ্রহের সময় তাদের মূল গাঠনিক অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। উদাহরণ সরূপ বোতলের ঢাকনা, সিগারেট বাট, এবং মাইক্রোবর্জ্য।
প্লাস্টিক দূষণের কারণ
“প্লাস্টিক দূষণ ” বিভিন্ন উৎস থেকে উদ্ভূত হয়। একক-ব্যবহারের প্লাস্টিক আইটেম যেমন ব্যাগ, বোতল এবং প্যাকেজিং সামগ্রীর ব্যাপক ব্যবহার প্লাস্টিক দূষণের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। এই আইটেমগুলি প্রায়শই একক ব্যবহারের পরে ফেলে দেওয়া হয়, যা ল্যান্ডফিল, জলাশয় এবং এমনকি মহাসাগরগুলিতেও জমা হতে পারে।
“প্লাস্টিক দূষণের “ আরেকটি উল্লেখযোগ্য উৎস হল অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা, যার ফলশ্রুতিতে অনুপযুক্ত নিষ্পত্তি এবং ময়লা ফেলা হয়। প্লাস্টিকের পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে ব্যক্তিদের মধ্যে সচেতনতার অভাবও সমস্যাটিতে অবদান রাখে।
প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব
বাংলাদেশে প্রতিদিন আট থেকে নয় লাখ টন “প্লাস্টিক বর্জ্য ” তৈরি হয়, তার মধ্যে শতকরা ৩৬ ভাগ পুনর্চক্রায়ণ, ৩৯ ভাগ ভূমি ভরাট এবং বাকি ২৫ ভাগ সরাসরি পরিবেশে দূষক হিসেবে যোগ হচ্ছে। প্লাস্টিকের দ্রব্যাদি মূলত জীবাস্ম জ্বালানি (পেট্রোলিয়াম অয়েল) থেকে পলিমার হিসেবে তৈরি করা হয়। তবে প্রস্তুতকালে নানা রকম সংযোজনকারী জৈব যৌগ যোগ করা হয়। পরিবেশে “প্লাস্টিক বর্জ ” নানা রকম মারাত্মক বিপজ্জনক জৈব যৌগ নিঃসরণ করে।
তার মধ্যে বিসফেনল-এ, ফথেলেটস, বিসফেনোন, অর্গানোটিনস, পার- এবং পলি ফ্লোরোঅ্যালকাইল পদার্থ এবং ব্রোমিনেটেড ফেইম রিটারডেন্টস উল্লেখযোগ্য। এসব “রাসায়নিক পদার্থ মানুষসহ অন্যান্য জীবের হরমোনাল সিস্টেম নষ্ট করে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। এছাড়া প্লাস্টিক বর্জ্য নিঃসৃত এসব রাসায়নিক পদার্থ স্নায়ুতন্ত্র এবং মস্তিষ্কের কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নানা রকম রোগ সৃষ্টি করতে পারে। ” ন্যানো প্লাস্টিক বর্জ্য এবং প্লাস্টিক বর্জ্য নিঃসৃত রাসায়নিক পদার্থ জীবের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন করতে পারে এবং ক্যান্সারসহ নানা রকম দুরারোগ্য ব্যাধির কারণ হতে পারে।
ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে ৬৪৬ টন “প্লাস্টিক বর্জ্য” তৈরি হচ্ছে। আমাদের এ প্রিয় শহরে আমরা ১ কোটি ৮০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে অবচেতন মনে অন্যান্য বর্জ্যের সঙ্গে ফেলে দিচ্ছি। একশর বেশি ফ্যাক্টরিতে এসব পলিথিন ব্যাগ তৈরি হয়। পলিথিন ব্যাগের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে জলাবদ্ধতাসহ ঢাকা শহর কতটা বাসযোগ্যহীন এবং আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে, তা সবার জানা।
যে উপায় মেনে চললে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো যায়
আমরা যত দ্রুত প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার থেকে নিজেদের বিরত রাখব, তত দ্রুত প্লাস্টিক-দূষিত পরিবেশ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারব। আমাদের ব্যবহার্য যে দ্রব্যটি পরিবেশ দূষণের পেছনে অন্যতম বড় অবদান রাখছে তা হলো প্লাস্টিক।আমরা প্রতিনিয়ত প্লাস্টিক ব্যবহার করছি এবং পরিবেশকে দূষিত করছি।
তাই পরিবেশ দূষণ রোধকল্পে প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহার কমিয়ে আনার ব্যাপারে সবাইকে তৎপর হতে হবে এবং ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্য যত্রতত্র না ফেলে এগুলো নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। আমাদের সবার এ বিষয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন যে, আমরা যত দ্রুত প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার থেকে নিজেদের বিরত রাখব, তত দ্রুত “প্লাস্টিক-দূষিত ” পরিবেশ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারব।
নিচে কয়েকটি উপায় তুলে ধরা হল
শিক্ষা এবং সচেতনতা
“প্লাস্টিক দূষণের ” বিপদ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষামূলক প্রচারণা পরিচালনা করুন। অল্প বয়স থেকেই পরিবেশের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে স্কুল ও কলেজে পরিবেশগত শিক্ষার প্রচার করুন।
সরকারী নীতি ও প্রবিধান
প্লাস্টিকের উৎপাদন, ব্যবহার এবং নিষ্পত্তি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে কঠোর নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হবে। একক-ব্যবহারের প্লাস্টিকের উপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করুন, টেকসই বিকল্পগুলিকে উৎসাহিত করুন এবং অ-সম্মতির জন্য জরিমানা আরোপ করুন।
গবেষণা এবং উদ্ভাবন
প্লাস্টিকের টেকসই বিকল্প খোঁজার জন্য গবেষণা ও উন্নয়নকে উৎসাহিত করুন। বায়োডিগ্রেডেবল উপকরণের প্রচার এবং মহাসাগর এবং জলাশয় থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিষ্কার করার জন্য প্রযুক্তিতে বিনিয়োগকারী উদ্যোগগুলিকে সমর্থন করে।
বেলুন
বেলুন পচনশীল না। এগুলো প্রানীদেহের ক্ষতি এবং মাটির সাথে মিশে খাদ্য গুনাগুণ নষ্ট করে ফেলে। কিন্তু শিশুদের কাছে বেলুন খুবই আকর্ষনীয় একটি বস্তু।তাছাড়া জন্মদিন বা কোনো অনুষ্ঠানে বেলুন না হলে যেনো চলেই না। কিন্তু বেলুনের পরিবর্তে কাগজের তৈরী পম্পম ব্যবহার করা যায়। পম্পম দিয়ে ঘর সাজালে তা যেমন ঘরের সৌন্দর্য্য রক্ষা করবে তেমনি পরিবেশ বান্ধবও হবে।
উপহার
শিশুদের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার খেলনা। কিন্তু এই প্লাস্টিকের তৈরী খেলনা গুলোই যে আমাদের জন্য হুমকি! তাই এমন খেলনা দেয়া যেতে পারে যাতে শিশু খুশিও থাকে আবার পরিবেশ বান্ধবও হয়। যেমন,কোনো কুপন,কার্ড,ঘরে তৈরী কোনো উপহার দেয়া যেতে পারে।
ঝুড়ি
আবর্জনা যত্রতত্র না ফেলে ঝুড়ি ব্যবহার করতে হবে। তা নাহলে এই ময়লাগুলোকে নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে স্তূপাকারে জমা করা হয়।যা নদীর পানি,মাছ সবকিছুকে নষ্ট করে দেয়। ঢাকার খাল-বিলের দিকে তাকালে দেখা যায় বর্জ্যের ভিড়ে কীভাবে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট হওয়ার পথে!
এলাকাভিত্তিক কর্মসূচি
নিজ নিজ এলাকায় এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। প্রতিবাড়ি থেকে প্লাস্টিক দ্রব্য অপসারণ,প্লাস্টিকের বদলে পরিবেশ বান্ধব অন্যকিছু ব্যবহারে পরামর্শ প্রদান,খতিকারক দিকগুলো তুলে ধরা এভাবে জনসচেতনতা তৈরী করা যেতে পারে।
পুনরায় ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য
এক গবেষনায় দেখা গেছে, আমেরিকানরা তাদের আবর্জনার মাত্র ৩৫% পুনরায় ব্যবহার করতে পারে। কীভাবে এগুলোকে ব্যবহার করা যায় বা কোন দ্রব্যগুলো পুনব্যবহারযোগ্য তা জেনে ব্যবহার করা যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে ,আমেরিকানরা দিনে ৫০কোটি প্লাস্টিক স্ট্র ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে কোনো ধাতুর তৈরী বা কাগজের স্ট্র ব্যবহার করা যায়।
নদীতে ময়লা ফেলা থেকে বিরত থাকা
নদী,পুকুরে,খালে ইচ্চেমতো ময়লা ফেলা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে। কারণ এগুলো পানি দূষণ করে এবং মাছগুলো মরে যায়। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বিশ্বের অর্ধেক জায়গাতেই সমুদ্রের বাসকারী কচ্ছপেরা মারা যায় এইসব “প্লাস্টিক,বর্জ্যের ” কারণে।
ক্লাব কর্মসুচি
স্কুলগুলোতে এই পরিবেশ বান্ধব বিভিন্ন ক্লাব খোলা যেতে পারে। যেখানে পরিবেশ রক্ষা সপ্তাহ , মিটিং, মেলার মতো কর্মসূচি থাকবে। এতেকরে শিশুদের মাঝে সচেতনতা বাড়বে, তারা দায়িত্বশীল এবং যত্নবান হবে পরিবেশ যত্নে।
পরিশেষে প্লাস্টিক দূষণ
পরিবেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো যেমন- মাটি, পানি, বায়ু প্রতিনিয়ত “প্লাস্টিক দ্বারা দূষিত” হচ্ছে। এছাড়া প্লাস্টিক স্টিরিন নামক ক্ষতিকর পদার্থ নির্গত করে, যা মানবদেহে তৈরি করতে পারে ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি। মোটকথা, প্লাস্টিক পদার্থটি কোনোভাবেই পরিবেশ ও মানবজীবনের জন্য উপকারী নয়। বরং এর ব্যবহারে পরিবেশ যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাতে এর বড় ধরনের মাশুল দিতে হচ্ছে মানুষকে।
তাই পরিবেশ দূষণ রোধকল্পে প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহার কমিয়ে আনার ব্যাপারে সবাইকে তৎপর হতে হবে এবং ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্য যত্রতত্র না ফেলে এগুলো নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। আমাদের সবার এ বিষয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন যে, আমরা যত দ্রুত প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার থেকে নিজেদের বিরত রাখব, তত দ্রুত “প্লাস্টিক-দূষিত ” পরিবেশ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারব।
আরও পড়ুন:
মিতব্যয়ী হওয়ার মূল্যবান পাঁচটি টিপস্
ক্যারিয়ার গঠনে কি কি গুণ ও দক্ষতা প্রয়োজন
দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত মোবাইলফোন ব্যবহারের সুফল ও কুফল
3 thoughts on “প্লাস্টিক দূষণ: আমাদের করণীয়”