পড়াশোনার পরিবেশ কেমন হওয়া উচিত?

Spread the love

আমরা সবাই জানি, ভালোভাবে পড়াশোনা করতে হলে শুধু বই বা নোট থাকলেই হয় না; দরকার হয় সঠিক পরিবেশ। যেমন, আপনি যদি শব্দযুক্ত রাস্তায় পড়তে বসেন, তখন মনোযোগ থাকবে তো? একদমই না। আবার যদি ঘরে আলো কম থাকে বা চারপাশ এলোমেলো থাকে, তাহলেও পড়ার ইচ্ছে হারিয়ে যায়। তাই সঠিক পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি করা আমাদের পড়ার মান এবং ফলাফল দুটোই ভালো করে।

অনেক সময় আমরা ভাবি—“পড়াশোনা তো যেকোনো জায়গায় করা যায়, তাহলে আলাদা পরিবেশ কেন দরকার?” কিন্তু আসলে পরিবেশ আমাদের মস্তিষ্ককে শান্ত রাখে, মনোযোগ বাড়ায় এবং সময় বাঁচায়। যেমন ধরুন, আপনার সামনে যদি টিভি চলে বা ফোন বাজতে থাকে, তখন কি পড়ার প্রতি মনোযোগ থাকে? না। বরং বিরক্ত লাগে, পড়া পিছিয়ে যায়। তাই পরিবেশ ঠিক না হলে যতই চেষ্টা করি, ফল ভালো হয় না।

পড়াশোনার পরিবেশ মানে শুধু শান্ত জায়গা নয়; এর মধ্যে আলো, বাতাস, বসার জায়গা, শব্দ নিয়ন্ত্রণ, প্রয়োজনীয় উপকরণ—সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ। যদি এগুলো সঠিকভাবে থাকে, তাহলে পড়া আনন্দদায়ক হয়, চাপ কমে যায় এবং মনে দীর্ঘদিন থাকে।

এই লেখায় আমরা ধাপে ধাপে জানবো কেমন পরিবেশে পড়াশোনা করা উচিত এবং কীভাবে সেই পরিবেশ তৈরি করা যায়। প্রতিটি ধাপে সহজ ভাষায় উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করা হবে, যাতে পড়ে আপনি বা ছোটরাও সহজেই বুঝতে পারে।

১। পড়াশোনার জন্য শান্ত এবং মনোযোগী জায়গা নির্বাচন

ভালোভাবে পড়াশোনা করতে হলে প্রথমেই যে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে তা হলো—আপনার চারপাশের পরিবেশ শান্ত কি না। চারপাশ যদি কোলাহলপূর্ণ হয়, যেমন টিভি চলছে, বাচ্চাদের খেলা হচ্ছে বা বাইরের হর্ন বাজছে, তখন মনোযোগ ধরে রাখা অসম্ভব। তাই প্রথম ধাপে দরকার এমন একটি জায়গা নির্বাচন করা যেখানে শব্দ কম থাকবে এবং মন সহজে এক জায়গায় রাখা যাবে।

শান্ত পরিবেশ মানেই শুধু নীরবতা নয়। এমন জায়গা খুঁজুন যেখানে আপনার মন স্বস্তি পায়। কারও জন্য সেটি হতে পারে ঘরের এক কোণ, কারও জন্য লাইব্রেরি বা স্কুলের স্টাডি রুম। যদি ঘরে ছোট ভাইবোন বা পরিবারের অন্যদের উপস্থিতির কারণে শান্ত জায়গা না পান, তাহলে পড়ার সময় সবার সঙ্গে কথা বলে নিতে পারেন যেন তারা বিরক্ত না করে।

মনোযোগী জায়গা বেছে নেওয়ার সময় আলো-বাতাসও গুরুত্বপূর্ণ। জানালার পাশে বসে পড়লে প্রাকৃতিক আলো ও বাতাস পাবেন, যা মন ফ্রেশ রাখে। আবার খুব অন্ধকার বা গুমোট ঘরে বসলে ঘুম চলে আসে, মাথা ব্যথাও হতে পারে। সঠিক আলো ব্যবহার করলে চোখের ওপর চাপ কম পড়ে।

এছাড়াও, বসার অবস্থান আরামদায়ক হওয়া দরকার। মেঝেতে শোয়ানো বা বিছানায় হেলান দিয়ে পড়লে মনোযোগ কমে যায়, শরীরও ক্লান্ত হয়। তাই টেবিল-চেয়ারে সোজা হয়ে বসে পড়া সবচেয়ে ভালো।

সবশেষে, চেষ্টা করুন পড়ার জায়গাটি শুধু পড়ার জন্য ব্যবহার করতে। এতে মস্তিষ্ক বুঝে যাবে—যখন আপনি ওই জায়গায় বসছেন, তখন কাজ মানে পড়াশোনা। ফলে মনোযোগ দ্রুত তৈরি হবে এবং পড়ার অভ্যাসও গড়ে উঠবে।

পড়াশোনার উপকরণগুলো সঠিকভাবে সাজানো ও প্রস্তুত রাখা

পড়াশোনার পরিবেশ ঠিক করার পরের ধাপ হলো প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো ঠিকভাবে সাজিয়ে রাখা। পড়া শুরু করার সময় যদি বারবার কলম, খাতা, বই বা ইরেজার খুঁজতে হয়, তাহলে মনোযোগ ভেঙে যায় এবং সময় নষ্ট হয়। তাই পড়ার আগে সবকিছু একসঙ্গে প্রস্তুত রাখা দরকার।

প্রথমেই ঠিক করুন কোন বিষয় পড়বেন এবং সেই বিষয়ের জন্য কী কী লাগবে। যেমন, গণিত পড়তে হলে ক্যালকুলেটর, জ্যামিতি বক্স, খাতা আর বই লাগবে। বাংলা বা ইংরেজি পড়তে হলে শুধু বই আর খাতা যথেষ্ট হতে পারে। পড়া শুরুর আগে এগুলো টেবিলে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখুন। এতে মাঝপথে উঠে যাওয়ার দরকার পড়বে না।

টেবিলের জিনিসপত্র পরিষ্কার রাখাও জরুরি। যদি টেবিল ভরে যায় অপ্রয়োজনীয় জিনিসে—মোবাইল ফোন, খেলনা, বা খাবারের প্যাকেট—তাহলে মনোযোগ সরাসরি পড়া থেকে সরে যাবে। তাই টেবিলে কেবল দরকারি জিনিস রাখুন। এভাবে জায়গা গুছিয়ে রাখলে পড়াশোনার পরিবেশ পরিষ্কার ও হালকা মনে হবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রযুক্তি ব্যবহারের নিয়ম। অনেক সময় পড়ার সময় মোবাইল বা ট্যাব দরকার হয় তথ্য খোঁজার জন্য, কিন্তু একইসঙ্গে এটি মনোযোগ নষ্টের বড় কারণ। তাই পড়াশোনার সময় ফোন সাইলেন্ট করে রাখুন বা অন্য ঘরে রেখে দিন। যদি দরকার হয়, শুধু পড়ার সঙ্গে সম্পর্কিত কাজের জন্য ব্যবহার করুন।

সব উপকরণ গুছিয়ে রাখলে পড়াশোনার মধ্যে একটা স্বাভাবিক প্রবাহ তৈরি হয়। মনোযোগ ভাঙে না, সময়ও বাঁচে। এতে পড়ার আনন্দ বাড়ে এবং শেখার মানও ভালো হয়।

সঠিক আলো ও বাতাসের ব্যবস্থা করা

পড়াশোনার জন্য আলো ও বাতাসের সঠিক ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন না, কিন্তু বাস্তবে এটি মনোযোগ, চোখের স্বাস্থ্যে ও শেখার দক্ষতায় সরাসরি প্রভাব ফেলে। যদি ঘর অন্ধকার হয় বা আলো কম থাকে, তখন চোখে চাপ পড়ে, মাথা ব্যথা করে এবং মনোযোগ ভেঙে যায়। অন্যদিকে, যদি ঘরে যথেষ্ট বাতাস না থাকে, তাহলে ঘুম ঘুম ভাব আসে, ক্লান্তি অনুভব হয়।

সবচেয়ে ভালো হয় দিনের বেলায় প্রাকৃতিক আলো ব্যবহার করা। জানালার পাশে বসে পড়লে সূর্যের আলো চোখের জন্য আরামদায়ক হয় এবং ঘরের পরিবেশও সতেজ থাকে। তবে অনেক সময় রাতের বেলা বা মেঘলা দিনে কৃত্রিম আলো ব্যবহার করতে হয়। সেক্ষেত্রে সাদা বা হালকা হলুদ আলো ব্যবহার করা ভালো, যা চোখে আরাম দেয় এবং পরিষ্কারভাবে পড়তে সাহায্য করে।

আলোর অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ। যদি আলো পেছন থেকে আসে, তাহলে ছায়া পড়ে এবং পড়তে অসুবিধা হয়। তাই আলো এমনভাবে রাখতে হবে যাতে সরাসরি বইয়ের ওপর পড়ে এবং চোখের দিকে না লাগে। ডানহাতি হলে আলো বাম দিক থেকে আসা ভালো, আর বাঁহাতি হলে ডান দিক থেকে—এতে হাতের ছায়া বইয়ের ওপর পড়বে না।

বাতাসের দিকেও নজর দিতে হবে। গুমোট বা বন্ধ ঘরে বসে পড়লে অক্সিজেনের অভাব হয়, যা মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই জানালা খোলা রেখে বা ফ্যান চালিয়ে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করুন। গরম কালে ঘর যদি বেশি গরম হয়, তাহলে হালকা ঠান্ডা পরিবেশ তৈরি করুন যাতে আরামবোধ হয়।

যদি পড়াশোনার পরিবেশ বাইরে হয়, যেমন লাইব্রেরি বা ক্লাসরুম, তখনও চেষ্টা করুন জানালার কাছে বা আলোর ভালো জায়গায় বসতে। কারণ ভালো আলো এবং বাতাস মনকে শান্ত রাখে, পড়ার আগ্রহ বাড়ায় এবং মনে দীর্ঘদিন ধরে রাখতে সাহায্য করে।

পড়াশোনার সময়সূচি ও বিরতির পরিকল্পনা করা

পড়াশোনার পরিবেশ শুধু জায়গা বা সরঞ্জামের ওপর নির্ভর করে না; সময় ব্যবস্থাপনাও একটি বড় অংশ। অনেকেই একটানা দীর্ঘ সময় পড়তে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে যায় এবং কিছুই মনে রাখতে পারে না। আবার কেউ কেউ এলোমেলো সময়ে পড়ে, ফলে পড়ার ধারাবাহিকতা ভেঙে যায়। তাই সঠিক সময়সূচি তৈরি করা ও বিরতি নেওয়ার পরিকল্পনা করা অত্যন্ত দরকারি।

প্রথমেই নিজের অভ্যাস ও সুবিধা অনুযায়ী সময় ঠিক করুন। যেমন কেউ সকালবেলা পড়তে ভালোবাসে, আবার কেউ রাতের দিকে বেশি মনোযোগী হয়। তবে যেকোনো সময় বেছে নিলেও চেষ্টা করুন প্রতিদিন একই সময়ে পড়তে। এতে মস্তিষ্কের মধ্যে একটি রুটিন তৈরি হবে, আর শরীরও অভ্যস্ত হয়ে যাবে।

সময় ভাগ করার সময় ‘পোমোডোরো’ পদ্ধতি কাজে লাগাতে পারেন—এটি হলো ২৫ মিনিট পড়া ও ৫ মিনিট বিরতি নেওয়া। চারবার এভাবে করার পর একটু বড় বিরতি (১৫–২০ মিনিট) নিতে পারেন। এভাবে পড়লে মনোযোগ বজায় থাকে এবং ক্লান্তি আসে না।

বিরতির সময় কী করবেন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। বিরতির সময় ফোনে গেম খেলা বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকে গেলে মনোযোগ আবার পড়ায় ফেরানো কঠিন হয়। এর বদলে পানি পান করা, হালকা হাঁটা বা জানালার বাইরে তাকানো ভালো। এতে মস্তিষ্ক ফ্রেশ হয় এবং পরবর্তী পড়া আরও কার্যকর হয়।

পড়াশোনার সময়সূচিতে ঘুম ও খাবারের সময়ও রাখতে হবে। যথেষ্ট ঘুম না হলে মনোযোগ ধরে রাখা যায় না, আর খালি পেটে পড়লে মন অস্থির হয়। তাই নিয়মিত বিরতি, সুষম খাবার এবং পর্যাপ্ত ঘুম মিলিয়ে পরিকল্পনা করলে পড়াশোনার পরিবেশ একদম পারফেক্ট হয়ে যায়।

মনোযোগ বাড়াতে অনুপ্রেরণামূলক পরিবেশ তৈরি করা

পড়াশোনার পরিবেশ শুধু শান্ত, পরিষ্কার বা সঠিক আলোর হওয়াই যথেষ্ট নয়; এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে যা আপনাকে পড়ায় উৎসাহিত করবে। অনেক সময় পড়তে বসে মনে হয় বিরক্ত লাগছে, কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না। তখন যদি চারপাশে এমন কিছু থাকে যা আপনাকে উৎসাহ দেয়, তাহলে পড়া আবার সহজ হয়ে যায়।

প্রথমেই ঘরকে নিজের পছন্দমতো সাজাতে পারেন। যেমন টেবিলের ওপর একটি সুন্দর মোটিভেশনাল উক্তি লিখে রাখুন—“আমি পারবো”, “আজকের পরিশ্রমই আগামী দিনের সাফল্য”—এগুলো পড়লে মনোবল বাড়ে। চাইলে দেয়ালে ছোট্ট একটি ক্যালেন্ডার রাখতে পারেন যেখানে পড়ার পরিকল্পনা বা লক্ষ্য লিখবেন। এতে প্রতিদিন নিজের অগ্রগতি দেখে অনুপ্রাণিত হবেন।

পড়ার পরিবেশে রঙের ব্যবহারও প্রভাব ফেলে। হালকা নীল বা সবুজ রঙ মন শান্ত রাখে, মনোযোগ বাড়ায়। তাই টেবিলক্লথ, দেয়াল বা স্টাডি ল্যাম্পে এসব রঙ ব্যবহার করতে পারেন। একইসঙ্গে ঘরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা খুব দরকার; অগোছালো ঘর মনকেও অগোছালো করে দেয়।

মনোযোগ ধরে রাখতে কিছু হালকা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও কাজে লাগতে পারে—বিশেষ করে ইন্সট্রুমেন্টাল সুর বা প্রকৃতির শব্দ। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন গানটি মনোযোগ সরিয়ে না নেয়। কেউ যদি সম্পূর্ণ নীরব পরিবেশে ভালো পড়তে পারে, সেটাই বেছে নেয়া উচিত।

সবশেষে, নিজেকে ছোট ছোট পুরস্কার দিতে পারেন। যেমন নির্দিষ্ট সময় পড়া শেষ হলে নিজের পছন্দের ফল খাওয়া বা একটু প্রিয় কাজ করা। এতে পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়বে এবং পড়ার অভ্যাসও নিয়মিত হবে।

উপসংহার: সঠিক পরিবেশেই সফল পড়াশোনা সম্ভব

পড়াশোনা শুধু বই পড়া বা নোট মুখস্থ করার ব্যাপার নয়; এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরিবেশ, মানসিক অবস্থা এবং সঠিক পরিকল্পনা। যদি পরিবেশ ঠিক না থাকে, তবে যত চেষ্টা করা হোক না কেন, মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়। শান্ত ও গুছানো জায়গা, সঠিক আলো-বাতাস, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের প্রস্তুতি, সময়ের পরিকল্পনা এবং অনুপ্রেরণামূলক পরিবেশ—এই পাঁচটি ধাপ মেনে চললে পড়াশোনা অনেক সহজ ও আনন্দময় হয়ে ওঠে।

আমরা যখন সঠিক পরিবেশে পড়ি, তখন শেখা দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং চাপও কম লাগে। একটানা পড়তে গিয়ে বিরক্ত না হয়ে বরং ধীরে ধীরে পড়ার প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। মনে রাখতে হবে, পরিবেশ তৈরি করা একবারের কাজ নয়; এটি প্রতিদিন যত্ন নিয়ে বজায় রাখতে হয়। যেমন টেবিল পরিষ্কার রাখা, আলো ঠিকমতো জ্বালানো বা প্রতিদিনের সময়সূচি মেনে চলা—এগুলো ছোট কাজ হলেও ফল বড়।

সবশেষে বলা যায়, পড়াশোনার পরিবেশ শুধু ভালো ফলের জন্য নয়, এটি মানসিক শান্তি ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও জরুরি। তাই আজ থেকেই নিজের চারপাশকে পড়াশোনার উপযোগী করে তুলুন। ছোট ছোট পরিবর্তন এনে বড় সাফল্যের পথে এগিয়ে যান—কারণ সঠিক পরিবেশই আপনাকে পড়াশোনায় এগিয়ে রাখবে।

Leave a Comment

You cannot copy content of this page