একটা সময় ছিল যখন শিশুরা ছুটির দিনে বই হাতে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্পের জগতে হারিয়ে যেত। বই ছিল তাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু, আনন্দের উৎস। কিন্তু আজকাল সেই চিত্র বদলে গেছে। এখন শিশুর হাতে বইয়ের বদলে স্মার্টফোন, গল্পের বদলে গেমস, কল্পনার বদলে স্ক্রিনের ঝলক। পাঠাভ্যাস যেন হারিয়ে ফেলেছে তার জায়গা।
এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে নানা কারণ — প্রযুক্তির আগ্রাসন, পরিবারিক উদাসীনতা, সময় ব্যবস্থাপনার অভাব, ও পাঠ্যবইয়ের বাইরে বিকল্প বইয়ের সংকট। এই ব্লগে আমরা পাঠাভ্যাস কমে যাওয়ার ৫টি মূল কারণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব এবং সেইসাথে দেখব কীভাবে আমরা আবারও শিশুদের মধ্যে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা ফিরিয়ে আনতে পারি।
১। পাঠাভ্যাস কী এবং কেন তা গুরুত্বপূর্ণ?
পাঠাভ্যাস মানে হলো নিয়মিত বই, পত্রিকা, বা যেকোনো লেখা পড়ার অভ্যাস। এই অভ্যাসটা ছোটবেলা থেকেই গড়ে উঠলে একজন শিশু শুধু বই পড়া নয়, জীবনের নানা জিনিস শেখার প্রতি আগ্রহী হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আজকের দিনে অনেক শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে পাঠাভ্যাস ক্রমশ কমে যাচ্ছে। আগে যেখানে শিশুরা অবসরে গল্পের বই খুলে বসত, এখন তারা মোবাইল ফোনে বা টিভির পর্দায় ব্যস্ত।
পাঠাভ্যাস একটি মানুষের মানসিক বিকাশে বড় ভূমিকা রাখে। এটা শুধু জ্ঞান অর্জনই নয়, বরং কল্পনাশক্তি, বিশ্লেষণ ক্ষমতা, ভাষার ব্যবহার ও চিন্তাধারার উন্নতিতেও সাহায্য করে। একটি শিশু যখন নিয়মিত পড়াশোনা করে বা গল্পের বই পড়ে, তার শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হয় এবং সে নিজের চিন্তাগুলো ভালোভাবে প্রকাশ করতে শেখে।
এই অভ্যাসটি ভবিষ্যতের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলে, তারা বড় হয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী এবং আত্মনির্ভরশীল হয়। স্কুলে ভালো করতে, পরীক্ষায় প্রশ্ন বুঝে উত্তর লিখতে বা জীবনের যেকোনো পর্যায়ে সমস্যা সমাধানে পাঠাভ্যাস অনেক কাজে আসে।
তবে সমস্যা তখনই শুরু হয়, যখন এই পাঠাভ্যাস ধীরে ধীরে কমে যায়। এই সময় বুঝে উঠতে হয় — কেন এমনটা হচ্ছে? কী কী কারণ পাঠাভ্যাস হারিয়ে যাওয়ার পেছনে কাজ করছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই আমরা এই লেখায় পাঁচটি ধাপে পাঠাভ্যাস কমে যাওয়ার মূল কারণগুলো বিশ্লেষণ করব।
২। প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার পাঠাভ্যাস কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ
আজকের শিশুদের হাতে এখন খুব ছোট বয়সেই স্মার্টফোন, ট্যাব বা ল্যাপটপ উঠে যাচ্ছে। তারা গল্পের বই পড়ার বদলে ইউটিউব ভিডিও দেখে, গেম খেলে বা কার্টুন দেখে সময় কাটাতে বেশি আগ্রহী। প্রথম দিকে এটা বিনোদন মনে হলেও, ধীরে ধীরে এটি একটি আসক্তিতে রূপ নেয়। যার ফলে শিশুরা বইয়ের পাতায় মন দিতে পারে না, কারণ বইয়ে তারা তেমন মজা বা উত্তেজনা পায় না।
অনেক সময় দেখা যায়, অভিভাবকরাও ব্যস্ততার কারণে সন্তানকে সামলাতে মোবাইল ফোন ধরিয়ে দেন। এতে তাৎক্ষণিকভাবে সন্তান শান্ত হয় ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সে বই পড়ার থেকে আরও দূরে সরে যায়। তারা চোখের সামনে থাকা প্রযুক্তিকে বেছে নেয়, যা এক ক্লিকে আনন্দ দেয় — কিন্তু কোনো চিন্তা বা কল্পনার সুযোগ দেয় না।
এছাড়া প্রযুক্তির এই অবাধ প্রবেশ শুধুই শিশুর নয়, বড়দের মাঝেও পড়ার ইচ্ছা কমিয়ে দিচ্ছে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আগে যে সময়টা আগে কেউ গল্পের বই বা উপন্যাস পড়তো, এখন সেই সময়টা কেটে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করতে করতে।
এই প্রযুক্তি নির্ভরতা শুধু সময় নষ্টই করে না, মনোযোগেরও ক্ষতি করে। শিশুরা দ্রুত বিরক্ত হয়ে পড়ে, আর বইয়ের মতো মনোযোগী হতে হয় এমন কিছুতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ফলে তারা গল্পের গভীরে যেতে পারে না, বা দীর্ঘ সময় ধরে কিছু পড়ার ধৈর্যও হারায়।
তাই পাঠাভ্যাস ফিরিয়ে আনতে প্রযুক্তির ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণে আনা খুবই জরুরি। অভিভাবকদের উচিত শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে দেওয়া — কখন তারা ডিভাইস ব্যবহার করতে পারবে আর কখন বই পড়তে হবে।
এই সমস্যার সমাধান প্রযুক্তিকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া নয়, বরং তা সঠিকভাবে ব্যবহার করা শেখানো। প্রযুক্তির পাশাপাশি বইকেও দৈনন্দিন জীবনের অংশ করে তুলতে পারলেই পাঠাভ্যাস আবার ফিরে আসবে।
৩। পরিবারের পাঠাভ্যাস ও উৎসাহের অভাব
একটি শিশুর প্রথম পাঠশালা তার পরিবার। পরিবারের সদস্যরা যেমনটা করে, শিশুরাও সাধারণত সেটাই অনুসরণ করে। কিন্তু যদি মা-বাবা নিজেরা বই না পড়েন, বা ঘরে বইপত্র না থাকে, তাহলে শিশুরাও বই পড়াকে গুরুত্ব দিতে শেখে না। বরং তারা দেখে সবাই মোবাইল চালাচ্ছে বা টিভি দেখছে, তখন তারাও সেই অভ্যাস গড়ে তোলে।
অনেক পরিবারে বইয়ের চেয়ে পরীক্ষার রেজাল্ট বা নম্বরকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এতে শিশুদের মনে হয় বই পড়া মানেই শুধু পরীক্ষার জন্য, আনন্দের জন্য নয়। ফলাফল কেন্দ্রিক এই দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে পাঠাভ্যাসকে দুর্বল করে দেয়। শিশুদের গল্প বা কল্পনার জগত তৈরি হওয়ার আগেই তা বন্ধ হয়ে যায়।
আরো একটি বিষয় হলো — অনেক সময় বাবা-মা শিশুর পড়ার ভুল ধরেন, রাগ করেন, কিন্তু তাদের উৎসাহিত করেন না। এতে শিশুর মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ হারিয়ে যায়। বরং যদি শিশু কিছু একটা পড়ে শোনায়, তখন পরিবারের সদস্যরা যদি আগ্রহ নিয়ে শুনে, প্রশ্ন করে বা প্রশংসা করে — তাহলেই সে উৎসাহ পায়।
শুধু শিশুর নয়, পরিবারের সব সদস্যের মাঝে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা দরকার। যদি প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় সব সদস্য মিলে একসাথে বই পড়ে, তাহলে তা একটি সুন্দর অভ্যাসে রূপ নেয়। তখন শিশুরা বুঝে — বই পড়া কোনো কাজ নয়, এটা আনন্দের বিষয়।
তাই পরিবারের দায়িত্ব শুধু খাবার বা পোশাক দেওয়া নয়, মানসিক বিকাশে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করাও। শিশুর হাতে যদি গল্পের বই তুলে দেওয়া হয়, তাদের সঙ্গে বইয়ের গল্প নিয়ে আলোচনা করা হয়, তাহলে তারা ধীরে ধীরে বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করে।
পরিবারই পারে বইকে ভালোবাসার মাধ্যম বানাতে — যেখানে গল্প, জ্ঞান আর আনন্দ মিলেমিশে নতুন পৃথিবী খুলে দেয়।
৪। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বিকল্প বইয়ের অভাব
অনেক শিশুই স্কুলের পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য কিছু পড়তে চায়, কিন্তু তাদের সামনে বিকল্প বইয়ের সুযোগ খুব কম থাকে। বেশিরভাগ স্কুলে শুধু সিলেবাসের বই নিয়ে চাপ থাকে, যেন পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট আসে — কিন্তু গল্পের বই, ছবি আঁকা বই বা ছড়ার বই পড়ার জন্য উৎসাহ বা সুযোগ তৈরি হয় না।
এছাড়া আমাদের অনেক লাইব্রেরিতেও শিশুদের উপযোগী বইয়ের সংখ্যা কম। যেসব বই থাকে, তার ভাষা কঠিন অথবা শিশুদের কাছে তা আগ্রহ জাগায় না। শিশুরা তখন ভাবে — বই মানেই কেবল কঠিন বিষয়, পড়তে একঘেয়েমি লাগে। অথচ যদি তাদের বয়স অনুযায়ী রঙিন, চিত্রসহ, কল্পনাপ্রবণ বই দেওয়া যেতো, তাহলে তারা সহজেই পড়ায় আকৃষ্ট হতো।
আরেকটি সমস্যা হলো — শিশুদের পছন্দের বিষয় নিয়ে বই খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেউ হয়তো মহাকাশ ভালোবাসে, কেউ জীবজন্তু বা পরীদের গল্প — কিন্তু বাজারে এসব বিষয়ের সহজ ভাষায় লেখা বই সহজে মেলে না। এর ফলে তারা আবার মোবাইল বা টিভির দিকে চলে যায়, যেখানে এসব বিষয়ের ওপর সহজেই ভিডিও পাওয়া যায়।
এভাবে ধীরে ধীরে পাঠাভ্যাস কমে যায়, কারণ বিকল্প কিছু না থাকলে শিশুদের মনোযোগ ধরে রাখা সম্ভব নয়। শুধু পাঠ্যপুস্তকের জগতে সীমাবদ্ধ থাকলে তাদের কল্পনার ডানা মেলে না, সৃজনশীলতাও বিকশিত হয় না।
শিশুদের মাঝে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা গড়তে হলে তাদের হাতে বৈচিত্র্যময় বই তুলে দিতে হবে। বই যেন হয় মজার, রঙিন, এবং শিক্ষামূলক। এতে তারা ভাববে — “বই মানেই শুধু পড়া নয়, বই মানে এক নতুন জগত ঘুরে আসা।”
পরিবার, স্কুল ও সমাজ যদি একসাথে বইয়ের জগৎকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে, তাহলেই পাঠ্যবইয়ের বাইরেও শিশুদের আগ্রহ জন্মাবে। আর তাতেই গড়ে উঠবে সত্যিকারের পাঠাভ্যাস।
৫। প্রতিযোগিতার চাপ ও সময় ব্যবস্থাপনার অভাব
বর্তমান সময়ের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটাই প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে। শিশুরা শুধু বই পড়া নয়, একাধিক কোচিং, হোমওয়ার্ক, প্রজেক্ট, ক্লাস টেস্ট — এসবের ভিড়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে নিজের মতো করে কিছু পড়ার সময়ই আর পায় না। ফলে তারা বইকে বোঝা মনে করে, আনন্দের মাধ্যম নয়।
এই চাপে তারা নিজের আগ্রহের বিষয় নিয়ে কিছু পড়তে চাইলেও সময় বের করতে পারে না। প্রতিদিন এত ব্যস্ত রুটিন — সকালে স্কুল, দুপুরে কোচিং, রাতে হোমওয়ার্ক — এই দৌড়ঝাঁপে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন বই পড়া আর শখ নয়, হয়ে ওঠে একটা চাপের কাজ।
শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, অভিভাবকদের মধ্যেও সময় ব্যবস্থাপনার অভাব আছে। অনেক সময় তারা সন্তানকে এত বেশি পড়ালেখার পেছনে ঠেলে দেয় যে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা গড়ে ওঠার সুযোগই থাকে না। আবার কেউ কেউ বই পড়াকে মূল্য দেয় না — তারা ভাবে শুধু পরীক্ষার প্রস্তুতিই যথেষ্ট।
এই অবস্থা থেকে বের হতে হলে সময় ব্যবস্থাপনাকে আরও মানবিক ও ভারসাম্যপূর্ণ করতে হবে। শিশুর রুটিনে কিছু সময় রাখতে হবে — যেখানে তারা নিজেদের পছন্দের বই পড়তে পারবে, চাপ ছাড়া, নিজের মতো করে।
এছাড়া স্কুল ও পরিবারের উচিত পরীক্ষাভিত্তিক মানসিকতা থেকে সরে এসে শিশুর মানসিক বিকাশ ও আনন্দের জায়গাকে গুরুত্ব দেওয়া। তাদের শেখাতে হবে যে, পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়া মানে নতুন কিছু জানা, কল্পনায় হারিয়ে যাওয়া, আর নিজের চিন্তাশক্তিকে বাড়ানো।
বই পড়া যেন প্রতিযোগিতার অংশ না হয়ে ওঠে — বরং হয়ে উঠুক আনন্দের বিষয়। তাহলেই পাঠাভ্যাস আবার ফিরবে শিশুদের মনে, বই হয়ে উঠবে তাদের জীবনের প্রিয় বন্ধু।
উপসংহার:
পাঠাভ্যাস একটি জাতির ভবিষ্যৎ গঠনের মূলে কাজ করে। একটি বই শুধু পৃষ্ঠা নয়, এটি চিন্তার জগৎ খুলে দেয়, ভাষা শেখায়, অনুভব জাগায়, এবং একজন মানুষকে পরিপূর্ণভাবে তৈরি করে। আজকের দিনে যেখানে পাঠাভ্যাস হারিয়ে যেতে বসেছে, সেখানে আমাদের সবাইকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রযুক্তি থাকবেই, প্রতিযোগিতাও চলবেই — কিন্তু তার মাঝেই সময় বের করে শিশুকে বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করানোটা আমাদের দায়িত্ব। পরিবার, শিক্ষক, সমাজ— সবার সম্মিলিত চেষ্টায় যদি বইয়ের প্রতি ভালোবাসা গড়ে তোলা যায়, তাহলে পাঠাভ্যাস আবার জীবন্ত হয়ে উঠবে। এবং তবেই আগামী প্রজন্ম গড়ে উঠবে জ্ঞানভিত্তিক, সৃজনশীল ও মানবিক এক সমাজে।