পর্যাপ্ত ঘুম কিভাবে হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করে?

Spread the love

আমাদের শরীরের সুস্থতা অনেকটাই নির্ভর করে পর্যাপ্ত ঘুমের উপর। শুধু ক্লান্তি দূর করার জন্য নয়, বরং শরীরের ভেতরে থাকা নানা হরমোনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য ঘুম খুবই জরুরি। যেমন, আমরা যখন ভালোভাবে ঘুমাই, তখন শরীর ঠিকভাবে ইনসুলিন, কর্টিসল, গ্রোথ হরমোনসহ নানা প্রয়োজনীয় হরমোন তৈরি ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। 

আবার ঘুম কম হলে এই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, যার ফলে ওজন বৃদ্ধি, মানসিক চাপ, এমনকি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যেতে পারে। তাই বোঝা যায়, সুস্থ জীবনের জন্য নিয়মিত ও পর্যাপ্ত ঘুম একেবারেই অপরিহার্য।

১। ঘুম ও হরমোনের সম্পর্ক বোঝা

আমাদের শরীরকে যদি আমরা একটি “ছোট্ট কারখানা” কল্পনা করি, তবে হরমোনগুলো হচ্ছে সেই কারখানার কর্মচারী। তারা আলাদা আলাদা কাজ করে শরীরকে সচল রাখে। কিন্তু এই কর্মচারীরা ঠিকভাবে কাজ করার জন্য বিশ্রাম দরকার হয়। আর সেই বিশ্রামের নামই হলো পর্যাপ্ত ঘুম

যখন আমরা নিয়মিত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমাই, তখন মস্তিষ্ক শরীরের হরমোন তৈরি ও নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পায়। ঘুমের সময় আমাদের শরীর গ্রোথ হরমোন নিঃসরণ করে, যা শরীরের বৃদ্ধি, কোষ মেরামত এবং শক্তি পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে। একই সঙ্গে ঘুমের মাধ্যমে ইনসুলিন হরমোন নিয়ন্ত্রণে থাকে, ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা সঠিক থাকে। ঘুম কম হলে ইনসুলিনের কাজ বিঘ্নিত হয় এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

এছাড়া ঘুম মানসিক চাপের হরমোন কর্টিসল নিয়ন্ত্রণে রাখে। ঘুম কম হলে কর্টিসলের মাত্রা বেড়ে যায়, ফলে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, মনোযোগ কমে যায় এবং শরীরে চর্বি জমার প্রবণতা বাড়ে। তাই নিয়মিত ঘুম মানসিক ও শারীরিক শান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, পর্যাপ্ত ঘুম লেপ্টিন ও ঘ্রেলিন নামক ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনকেও ভারসাম্যে রাখে। লেপ্টিন ক্ষুধা কমাতে সাহায্য করে আর ঘ্রেলিন ক্ষুধা বাড়ায়। ঘুম কম হলে লেপ্টিন কমে যায় এবং ঘ্রেলিন বেড়ে যায়, ফলে আমরা বেশি খেতে শুরু করি এবং ওজন বাড়তে থাকে।

সহজভাবে বলা যায়, ঘুম হলো শরীরের প্রাকৃতিক রিমোট কন্ট্রোল। এই রিমোটের মাধ্যমে হরমোনগুলো সঠিকভাবে কাজ করে, শরীর থাকে সুস্থ এবং মন থাকে প্রফুল্ল।

২। পর্যাপ্ত ঘুম ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার হরমোন

আমাদের শরীর প্রতিদিন অসংখ্য জীবাণু ও ভাইরাসের আক্রমণের মুখোমুখি হয়। কিন্তু শরীরে একটি বিশেষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে, যাকে বলে ইমিউন সিস্টেম। এই ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী রাখতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ হরমোন কাজ করে, যেমন মেলাটোনিনগ্রোথ হরমোন। আর এই হরমোনগুলো কার্যকরভাবে কাজ করার জন্য প্রয়োজন হয় পর্যাপ্ত ঘুম

যখন আমরা রাতে ভালো ঘুমাই, তখন শরীর থেকে মেলাটোনিন নামক হরমোন নিঃসৃত হয়, যা শুধু ঘুম আনতে সাহায্য করে না, বরং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও শক্তিশালী করে। এটি শরীরের কোষগুলোকে রক্ষা করে এবং জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে। অন্যদিকে ঘুম কম হলে মেলাটোনিনের মাত্রা কমে যায়, ফলে শরীর সহজেই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।

গ্রোথ হরমোনও রোগ প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখে। এটি ঘুমের গভীর পর্যায়ে নিঃসৃত হয় এবং শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত কোষ মেরামত করে। যেমন ধরুন, সারাদিন কাজ বা খেলাধুলায় ক্লান্ত শরীরকে ঘুমের সময় গ্রোথ হরমোন নতুন করে শক্তি জোগায়। ঘুম কম হলে এই হরমোন ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।

এছাড়া ঘুম আমাদের শরীরের প্রদাহ কমায়। ঘুম কম হলে কর্টিসল বেড়ে যায়, যা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। এর ফলে ঠান্ডা-কাশি, জ্বর, এমনকি দীর্ঘমেয়াদী রোগও সহজে আক্রমণ করতে পারে।

সহজ কথায়, পর্যাপ্ত ঘুম হলো শরীরের প্রাকৃতিক ভ্যাকসিন। এটি আমাদের ভেতরের সেনাদের (হরমোন) সক্রিয় রাখে এবং জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত করে।

৩। ঘুম ও মানসিক স্বাস্থ্যের হরমোন

শরীরের মতোই আমাদের মনেরও যত্ন দরকার। এই যত্ন নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কিছু হরমোন, যেমন সেরোটোনিন, ডোপামিন এবং কর্টিসল। পর্যাপ্ত ঘুম এই হরমোনগুলোকে ভারসাম্যে রাখে, ফলে মন ভালো থাকে, চিন্তাশক্তি বাড়ে এবং মানসিক চাপ কমে যায়।

প্রথমেই আসি সেরোটোনিন নিয়ে। এটাকে অনেকে “হ্যাপিনেস হরমোন” বলে থাকে। পর্যাপ্ত ঘুম হলে সেরোটোনিনের নিঃসরণ সঠিকভাবে হয়, ফলে মন শান্ত থাকে, দুশ্চিন্তা কমে এবং আমরা সহজে খুশি অনুভব করি। কিন্তু ঘুম কম হলে সেরোটোনিনের মাত্রা কমে যায়, যার ফলে উদ্বেগ, খিটখিটে মেজাজ বা এমনকি ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে।

এবার আসি ডোপামিন এ। এটি আমাদের প্রেরণা, মনোযোগ এবং শেখার ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। আমরা যখন ভালো ঘুমাই, তখন মস্তিষ্কে ডোপামিন ঠিকভাবে কাজ করে, ফলে মনোযোগ ধরে রাখা সহজ হয় এবং সৃজনশীলতাও বাড়ে। ঘুম কম হলে ডোপামিনের ভারসাম্য নষ্ট হয়, ফলে মনোযোগ কমে যায় এবং শেখার ক্ষমতাও দুর্বল হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে, ঘুম মানসিক চাপের হরমোন কর্টিসল কমাতে সাহায্য করে। আমরা যদি পর্যাপ্ত ঘুম না পাই, তাহলে কর্টিসলের মাত্রা বেড়ে যায়, যার ফলে মস্তিষ্ক সবসময় “চাপের মধ্যে” থাকতে শুরু করে। এতে দীর্ঘমেয়াদে উদ্বেগ, অস্থিরতা এবং মানসিক ক্লান্তি বাড়তে থাকে।

সহজভাবে বললে, পর্যাপ্ত ঘুম আমাদের মস্তিষ্ককে রিফ্রেশ বাটন চাপার মতো কাজ করে। এটি মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে, মনকে প্রফুল্ল করে এবং প্রতিদিন নতুন করে কাজ করার শক্তি দেয়।

৪। ঘুম ও বিপাকক্রিয়ার (Metabolism) সঙ্গে হরমোনের সম্পর্ক

আমাদের শরীর প্রতিদিন খাবার থেকে শক্তি পায়, আর সেই শক্তি ঠিকভাবে ব্যবহার করার প্রক্রিয়াকে বলে বিপাকক্রিয়া বা Metabolism। এই বিপাকক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখে কিছু হরমোন—যেমন ইনসুলিন, লেপ্টিনঘ্রেলিন। পর্যাপ্ত ঘুম এই হরমোনগুলোর ভারসাম্য রক্ষা করে, ফলে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং শক্তি সঠিকভাবে ব্যবহার হয়।

প্রথমে আসি ইনসুলিন নিয়ে। এটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা যখন পর্যাপ্ত ঘুমাই, তখন ইনসুলিন সঠিকভাবে কাজ করে এবং শরীরের কোষগুলো সহজে শক্তি পেতে পারে। কিন্তু ঘুম কম হলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়, যার ফলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

এরপর লেপ্টিনঘ্রেলিন। এই দুই হরমোন ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে। লেপ্টিন আমাদের শরীরকে বলে দেয় “পেট ভরে গেছে”, আর ঘ্রেলিন আমাদের ক্ষুধা বাড়ায়। যখন পর্যাপ্ত ঘুম হয়, তখন এ দুটো হরমোন ভারসাম্যে থাকে। কিন্তু ঘুম কম হলে লেপ্টিন কমে যায় এবং ঘ্রেলিন বেড়ে যায়। এর মানে, আমরা বেশি ক্ষুধার্ত বোধ করি এবং অপ্রয়োজনীয়ভাবে খাবার খেতে শুরু করি। ফলে ওজন দ্রুত বেড়ে যায়।

এছাড়া ঘুমের অভাবে কর্টিসল বাড়ে, যা শরীরে চর্বি জমাতে সাহায্য করে। এজন্যই অনিদ্রায় ভোগা মানুষরা প্রায়ই অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতার সমস্যায় পড়েন।

সহজভাবে বললে, পর্যাপ্ত ঘুম হলো শরীরের “ওজন নিয়ন্ত্রণের গোপন অস্ত্র”। এটি বিপাকক্রিয়াকে সঠিক রাখে, শক্তি ব্যবহারের সঠিক ছন্দ বজায় রাখে এবং শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।

৫। ঘুম, হরমোন ও দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সুরক্ষা

শুধু আজকের জন্য নয়, পর্যাপ্ত ঘুম আমাদের দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্যও অত্যন্ত জরুরি। কারণ ঘুম শরীরে হরমোনের এমন ভারসাম্য তৈরি করে, যা ভবিষ্যতে বড় বড় রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

উদাহরণস্বরূপ, পর্যাপ্ত ঘুম হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমায়। যখন আমরা নিয়মিত ভালো ঘুমাই, তখন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন ঠিকভাবে কাজ করে। ঘুম কম হলে কর্টিসল বেড়ে যায়, যা দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্‌রোগ এমনকি স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।

এছাড়া পর্যাপ্ত ঘুম হরমোনজনিত সমস্যাগুলো কমাতে সাহায্য করে। যেমন: থাইরয়েড হরমোন ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে ঘুমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ঘুমের অভাবে থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা শরীরের শক্তি ব্যবহার, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে।

ঘুম আরও সাহায্য করে প্রজনন হরমোনের ভারসাম্যে। নারী-পুরুষ উভয়ের প্রজনন ক্ষমতা ও হরমোনের কার্যকারিতা বজায় রাখতে পর্যাপ্ত ঘুম অপরিহার্য। ঘুমের অভাবে মাসিক চক্রে অনিয়ম, হরমোনজনিত বন্ধ্যাত্ব বা হরমোন সংক্রান্ত অন্যান্য জটিলতা দেখা দিতে পারে।

সবশেষে, পর্যাপ্ত ঘুম শরীরকে বার্ধক্য রোধে সাহায্য করে। কারণ গ্রোথ হরমোন ও মেলাটোনিন কোষ মেরামত করে, নতুন কোষ তৈরি করে এবং ত্বককে টানটান রাখে। যারা নিয়মিত ভালো ঘুমান, তারা সাধারণত সতেজ ও সুস্থ থাকেন।

সহজভাবে বললে, পর্যাপ্ত ঘুম হলো সুস্থ দীর্ঘ জীবনের এক অদৃশ্য ওষুধ। এটি শরীরের ভেতরের হরমোন সেনাদের ভারসাম্যে রাখে এবং ভবিষ্যতের বড় স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো থেকে আমাদের রক্ষা করে।

উপসংহার 

পর্যাপ্ত ঘুম শুধু ক্লান্তি দূর করে না, বরং শরীরের ভেতরের অদৃশ্য হরমোন সেনাদেরও ভারসাম্যে রাখে। ঘুম ঠিক থাকলে ইনসুলিন, কর্টিসল, সেরোটোনিন, লেপ্টিন, গ্রোথ হরমোনসহ নানা হরমোন সঠিকভাবে কাজ করে। এর ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে, মানসিক চাপ কমে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হয় এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাস পায়। সহজভাবে বলা যায়, ঘুম হলো শরীর ও মনের প্রাকৃতিক ওষুধ। তাই সুস্থ থাকতে, শক্তি ধরে রাখতে এবং সুন্দর জীবন যাপন করতে হলে নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘুমের অভ্যাস গড়ে তোলা একেবারেই অপরিহার্য।

Leave a Comment

You cannot copy content of this page