নেতিবাচক চিন্তা আমাদের মনকে ভারী করে তোলে এবং দৈনন্দিন কাজকে কঠিন মনে করায়। তাই এই চিন্তাগুলোকে দূরে রেখে ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইতিবাচক ভাবনা শুধু শান্তি দেয় না, বরং কাজকে সহজ করে, আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং জীবনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।
ছোট ছোট অভ্যাসের মাধ্যমেও আমরা মনকে শক্তিশালী ও হাসিখুশি রাখতে পারি। যেমন—ভাল দিক খোঁজা, কৃতজ্ঞ থাকা, নিজের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলা। এই লেখায় সহজ ভাষায় এমন কিছু ধাপ তুলে ধরা হবে, যা অনুসরণ করলে ৭ বছরের বাচ্চাও বুঝতে পারবে এবং বড়রাও জীবনে কাজে লাগাতে পারবে।
১। নিজের চিন্তা চিনে নেওয়া এবং থামাতে শেখা
ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখার প্রথম ধাপ হলো নিজের মাথায় কী ধরনের চিন্তা চলছে তা খেয়াল করা। আমরা অনেক সময় বুঝিই না কখন আমাদের মাথায় নেতিবাচক ভাবনা ঢুকে পড়ে। যেমন—“আমি পারব না”, “আমার কিছুই ঠিক হয় না”, “সবাই আমাকে অপছন্দ করে”—এসব ভাবনা ধীরে ধীরে মনকে দুর্বল করে। তাই প্রথম কাজ হলো এসব চিন্তা ধরা। যখনই মনে হবে এমন চিন্তা এসেছে, তখন একটু থামুন এবং নিজের সাথে প্রশ্ন করুন—“এটা কি সত্য?” বেশিরভাগ সময়ই দেখবেন এসব ভাবনা বাস্তবের সাথে মিল নেই।
নেতিবাচক চিন্তা থামাতে একটি সহজ কৌশল হলো থামো–বদলাও–হাসো পদ্ধতি। প্রথমে “থামো”—যখন বুঝবেন খারাপ ভাবনা এসেছে। তারপর “বদলাও”—সেই ভাবনাকে বদলে দিন ভালো বা বাস্তবসম্মত কথায়। যেমন “আমি পারব না” ভাবনার বদলে বলুন, “আমি চেষ্টা করলে অবশ্যই শিখতে পারব।” শেষ ধাপ “হাসো”—নিজেকে একটু হাসুন, কারণ হাসি আমাদের মনকে হালকা করে এবং মস্তিষ্ককে ইতিবাচক সংকেত পাঠায়।
এভাবে চিন্তা থামানোর অভ্যাস ছোট থেকে বড় সবাই গড়ে তুলতে পারে। একটি মজার পদ্ধতি হলো মনে মনে ‘স্টপ’ বোতাম চাপা। যখনই নেতিবাচক চিন্তা আসবে, মনে কল্পনা করুন যে আপনি একটি বড় লাল বোতাম চাপছেন এবং সেই চিন্তাকে বন্ধ করে দিচ্ছেন। এই পদ্ধতি শিশুদের জন্য যেমন উপযোগী, বড়দের জন্যও তেমন কার্যকরী।
আরেকটি উপায় হলো নিজের মনকে বন্ধুর মতো কথা বলা। যেমন বলুন, “শান্ত হও, সব ঠিক হয়ে যাবে।” যখন আমরা নিজেদের প্রতি কোমল হই, মনও ধীরে ধীরে ইতিবাচক হয়ে ওঠে। প্রতিদিন মাত্র কয়েক মিনিট নিজের চিন্তা বোঝার চর্চা করলে মনের উপর ভালো নিয়ন্ত্রণ তৈরি হয়। এতে আপনি সহজে নেতিবাচকতা এড়িয়ে চলতে পারবেন এবং জীবনের ভালো দিকগুলো স্পষ্টভাবে দেখতে পারবেন।
২। কৃতজ্ঞতার অভ্যাস গড়ে তোলা
ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখার সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর পদ্ধতিগুলোর একটি হলো কৃতজ্ঞতা চর্চা করা। কৃতজ্ঞতা মানে হচ্ছে আমরা যা পেয়েছি বা যা আছে, সেগুলোর জন্য মন থেকে ধন্যবাদ জানানো। এই অভ্যাস আমাদের মনকে ভালো দিক দেখতে সাহায্য করে এবং নেতিবাচক চিন্তা দূরে রাখে। যেমন—সকালে ঘুম থেকে উঠে বলতে পারেন, “আজকের নতুন দিনটার জন্য আমি খুশি।” কিংবা রাতে ঘুমানোর আগে ভাবুন, “আজকে অন্তত একটি ভালো ঘটনা ঘটেছে।” এমন ছোট্ট চিন্তাগুলো মনকে অনেক শান্ত এবং শক্তিশালী করে তোলে।
কৃতজ্ঞতার অভ্যাস গড়তে একটি সহজ উপায় হলো কৃতজ্ঞতার তালিকা তৈরি করা। ছোটরা যেমন তাদের প্রিয় খেলনা বা খাবারের জন্য খুশি হয়, বড়রাও ঠিক একইভাবে প্রতিদিন কয়েকটি জিনিস লিখতে পারেন যেগুলোর জন্য তারা কৃতজ্ঞ। যেমন—পরিবার, বন্ধু, পড়াশোনা করার সুযোগ, সুস্বাস্থ্য বা একটি সুন্দর আবহাওয়া—যাই হোক না কেন। এই তালিকা তৈরির ফলে দিনের শেষে মন খারাপ থাকলেও সুখের অনুভূতি ফিরে আসে, কারণ আপনি বুঝতে পারেন যে জীবনে অনেক ভালো জিনিস আছে।
একটি আরেকটি মজার অভ্যাস হলো “ধন্যবাদ মুহূর্ত” তৈরি করা। দিনের মধ্যে যখনই কিছু ভালো ঘটে—যেমন কেউ সাহায্য করল, আপনার কাজ সহজ হলো, বা আপনি হাসলেন—তখন মনে মনে বলুন “ধন্যবাদ।” এই ছোট্ট শব্দটি আমাদের মনকে তৎক্ষণাৎ ইতিবাচক করে তোলে। এমনকি আপনি চাইলে আপনার শিশুকেও এই অভ্যাস শেখাতে পারেন। এতে তারা ছোট থেকেই জীবনের ভালো দিকগুলো দেখতে শিখবে।
গবেষণায় দেখা যায়, কৃতজ্ঞতার চর্চা স্ট্রেস কমায়, মনের চাপ হ্রাস করে এবং আমাদের সুখী হতে সাহায্য করে। কারণ যখন আমরা ভালো জিনিসগুলোর দিকে মন দিই, তখন নেতিবাচক চিন্তা নিজেদের জায়গা খুঁজে পায় না। নিয়মিত কৃতজ্ঞ হওয়ার অভ্যাস আপনাকে আরও শান্ত, আত্মবিশ্বাসী এবং ইতিবাচক ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তুলবে।
৩। নিজের সাথে ইতিবাচকভাবে কথা বলার অভ্যাস তৈরি করা
আমাদের মনের ভেতরে একটি অদৃশ্য “কথাবলার মানুষ” থাকে, যাকে আমরা নিজের ভেতরের কণ্ঠ বলতে পারি। এই ভেতরের কণ্ঠটি অনেক সময় আমাদের সাহস দেয়, আবার অনেক সময় ভয় দেখায়। যদি এই কণ্ঠটি বারবার বলে, “তুমি পারবে না”, “তোমার কিছুই ঠিক হয় না”—তাহলে মন ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই এই ধাপের মূল লক্ষ্য হলো নিজের সাথে সুন্দর, কোমল এবং ইতিবাচকভাবে কথা বলার অভ্যাস তৈরি করা। কারণ নিজের কথাই প্রথমে আমাদের মনকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে।
ইতিবাচকভাবে কথা বলা মানে মিথ্যা বলা নয়। এর মানে হলো বাস্তবতা বুঝে নিজের প্রতি বন্ধুর মতো আচরণ করা। যেমন—“আজকে কাজটা কঠিন ছিল, কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি”—এটি একটি ইতিবাচক কথা। আবার “আমি সব সময় ব্যর্থ”—এটি নেতিবাচক। যখন নিজের সাথে বন্ধুর মতো কথা বলি, তখন মন শান্ত হয় এবং ভুল থেকে শেখা সহজ হয়। ঠিক যেমন একজন ভালো বন্ধু বলে, “আরে, চেষ্টা করো, তুমি পারবে”—আপনিও নিজের জন্য এমন কথা বলতে পারেন।
একটি কার্যকর কৌশল হলো ইতিবাচক বাক্য (Affirmation) ব্যবহার করা। আপনি প্রতিদিন সকালে বা রাতে কিছু শক্তিশালী বাক্য বলতে পারেন—
- “আমি চেষ্টা করলে শেখা সম্ভব।”
- “আমি আমার ভুল থেকে শিখি।”
- “আজকের দিনটি ভালো যাবে।”
- “আমি ভালো কিছু করার ক্ষমতা রাখি।”
এই বাক্যগুলো মস্তিষ্ককে নতুনভাবে ভাবতে শেখায় এবং ধীরে ধীরে নেতিবাচক চিন্তার জায়গা কমিয়ে দেয়।
আরেকটি পদ্ধতি হলো চিন্তা লিখে ফেলা। যদি মাথায় নেতিবাচক কথা আসে, একটি কাগজে লিখুন। তারপর তার পাশে লিখুন এটি কীভাবে অন্যভাবে বলা যায়। যেমন—“আমি ভয় পাচ্ছি”—এর বদলে লিখুন—“আমি ভয় পেয়েছি, কিন্তু চেষ্টা করলে এটা করতে পারব।” এই অনুশীলনটি শিশুদের জন্য যেমন সহজ, বড়দের জন্যও তেমন কার্যকর।
নিয়মিত নিজের সাথে ইতিবাচকভাবে কথা বলা মনকে শক্ত করে, আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস তৈরি করে। যখন আপনি নিজের সাথেই একজন ভালো বন্ধু হয়ে যান, তখন নেতিবাচক চিন্তা আপনাকে সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।
৪। নিজের চারপাশকে ইতিবাচক পরিবেশে সাজানো
আমরা যে পরিবেশে থাকি, দেখি এবং শুনি—তা আমাদের মনের উপর শক্তিশালী প্রভাব ফেলে। যদি চারপাশে সব সময় ঝগড়া, অভিযোগ বা দুঃখজনক কথা থাকে, তাহলে মন নিজেও নেতিবাচক হয়ে পড়ে। আর যদি চারপাশে হাসি, উত্সাহ এবং শান্ত পরিবেশ থাকে, তখন মন খুব দ্রুত ইতিবাচক হয়ে ওঠে। তাই নিজের মনকে ভালো রাখতে হলে প্রথমে নিজের আশেপাশে একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন।
ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করতে খুব বড় কিছু করতে হবে না। ছোট ছোট পরিবর্তনই অনেক বড় ফল দেয়। যেমন—নিজের ঘর পরিষ্কার রাখা, জানালা খুলে আলো-বাতাস ঢুকতে দেওয়া, নিজের পছন্দের রঙের কিছু জিনিস ব্যবহার করা—এসবই মনকে ভালো রাখতে সাহায্য করে। কারণ পরিষ্কার ও আরামদায়ক পরিবেশ মস্তিষ্ককে শান্ত করে এবং মনকে সতেজ করে তোলে। এমনকি বয়স কম শিশু পর্যন্ত তাদের খেলনার জায়গা পরিপাটি থাকলে বেশি আনন্দ অনুভব করে।
মানুষও পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদি চারপাশে এমন লোক থাকে যারা সবসময় হতাশার কথা বলে বা অন্যকে ছোট করে, তাহলে মন দ্রুত নেতিবাচক হয়ে যেতে পারে। তাই যতটা সম্ভব এমন মানুষদের সঙ্গে সময় কাটান যারা আপনাকে উত্সাহ দেয়, হাসায় এবং ভালো কিছু করতে অনুপ্রাণিত করে। তাদের কথাবার্তা, আচরণ এবং ইতিবাচক মনোভাব আপনার মনেও ভালো প্রভাব ফেলবে। এটাকে বলা হয় “পজিটিভ সোশ্যাল সার্কেল”—যা শিশু ও বড় সবার জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করতে ডিজিটাল দুনিয়ার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আমরা দিনে অনেক সময় ফোনে কাটাই, তাই সেখানে কী দেখি তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি সবসময় দুঃখের খবর, নেতিবাচক মন্তব্য বা ঝগড়ার ভিডিও দেখি, তাহলে মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। তাই চেষ্টা করুন হাসির ভিডিও, অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প, শিক্ষামূলক কনটেন্ট বা সুন্দর প্রকৃতির ছবি দেখতে। এগুলো মনকে শান্ত করে এবং ভালো মুড তৈরি করে।
নিজের চারপাশকে সুন্দর, শান্ত এবং ইতিবাচক রাখলে মনও সেই পরিবেশের মতোই হয়ে যায়। এই পরিবেশ আপনাকে প্রতিদিন নতুনভাবে শুরু করতে সাহায্য করে এবং নেতিবাচক চিন্তা থেকে দূরে রাখে।
৫। নিজের দৈনন্দিন অভ্যাসে আনন্দ ও বিশ্রাম যোগ করা
মনের ইতিবাচকতা বজায় রাখতে শুধু চিন্তা বদলালেই হয় না, শরীরকেও আরাম দিতে হয়। আমাদের মস্তিষ্ক ও মন দুটোই তখনই ভালোভাবে কাজ করে যখন আমরা নিয়মিত বিশ্রাম নিই এবং আনন্দ পাই। তাই প্রতিদিনের জীবনে এমন কিছু কাজ রাখা জরুরি যেগুলো আপনাকে খুশি করে, রিল্যাক্স করে এবং টেনশন কমায়। এই ধাপটি মূলত নিজের প্রতি যত্ন নেওয়া—যাতে মন শক্ত থাকে এবং নেতিবাচক চিন্তা সহজে মাথায় ঢুকতে না পারে।
একটি সহজ অভ্যাস হলো প্রতিদিন কয়েক মিনিট গভীর শ্বাস নেওয়া। গভীর শ্বাস মনকে শান্ত করে, রক্তচাপ কমায় এবং শরীরে অক্সিজেন বাড়ায়। আপনি বা একটি ছোট শিশুও সহজেই এই অভ্যাস করতে পারে। ৫ সেকেন্ড শ্বাস নিন, ৩ সেকেন্ড ধরে রাখুন, ৫ সেকেন্ড ছাড়ুন। এটি দিনে তিন–চারবার করলেই মন অনেক হালকা মনে হবে।
আরেকটি অত্যন্ত কার্যকর অভ্যাস হলো হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম। যখন আমরা শরীর নড়াচড়া করি, তখন শরীরে “ফিল-গুড হরমোন” বের হয়, যা মুড ভালো করে এবং স্ট্রেস কমায়। প্রতিদিন ১৫–২০ মিনিট হাঁটলেই আপনি নিজেই অনুভব করবেন মন কতটা ভালো থাকে। এমনকি বাচ্চারাও খেলাধুলা করলে একইভাবে খুশি হয়। তাই সক্রিয় থাকা মনকে ইতিবাচক করে।
এছাড়া প্রতিদিন কিছু সময় নিজের প্রিয় কাজ করার জন্য রাখুন। এটি হতে পারে গান শোনা, বই পড়া, ছবি আঁকা, গাছের যত্ন নেওয়া বা যেকোনো শখ। এসব কাজ মনকে খুশি করে এবং নেতিবাচক চিন্তা ভুলিয়ে দেয়। ছোট একটি শখও আমাদের দিনে আনন্দ যোগ করে এবং সেই আনন্দ আমাদের মানসিক শক্তি বাড়ায়।
সবশেষে, পর্যাপ্ত ঘুম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন আমরা ভালোভাবে ঘুমাই, তখন মন সতেজ হয়, দুশ্চিন্তা কমে এবং আমরা পরিষ্কারভাবে ভাবতে পারি। ঘুম কম হলে মুড খারাপ হয় এবং ছোট বিষয়েও বিরক্ত লাগে। তাই প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং অন্তত ৭–৮ ঘণ্টা বিশ্রাম নেওয়া মন ও শরীরকে সুস্থ রাখে।
নিজের দৈনন্দিন অভ্যাসে আনন্দ, খেলাধুলা, বিশ্রাম এবং নিজের প্রতি যত্ন যোগ করলে আপনার মন শক্তিশালী, শান্ত এবং ইতিবাচক থাকবে। এতে নেতিবাচক চিন্তাগুলো সহজেই দূরে সরে যাবে, আর আপনি প্রতিদিন আরও সুখী অনুভব করবেন।
উপসংহার
নেতিবাচক চিন্তা আমাদের মনকে দুর্বল করে, কিন্তু ছোট ছোট অভ্যাসের মাধ্যমে আমরা সহজেই ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে পারি। নিজের চিন্তা চেনা, কৃতজ্ঞ থাকা, নিজেকে উৎসাহ দেওয়া, ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি এবং আনন্দ–বিশ্রামকে গুরুত্ব দেওয়া—এগুলো প্রতিদিনের জীবনে মনকে শক্ত করে।
এই ধাপগুলো অনুসরণ করলে শুধু চাপ কমবে না, বরং আত্মবিশ্বাস বাড়বে এবং জীবন আরও শান্ত ও সুখী মনে হবে। যে কেউ, এমনকি ৭ বছরের শিশু পর্যন্ত, সহজেই এই অভ্যাসগুলো শিখতে পারে। নিজের প্রতি যত্নবান হলে মনও আপনার প্রতি যত্নবান হবে।
নেতিবাচক চিন্তা এড়িয়ে ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখা সম্পর্কে ১০ টি সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর।
প্রশ্ন–১। নেতিবাচক চিন্তা কী এবং এটি কেন ক্ষতিকর?
নেতিবাচক চিন্তা হলো সেই সব ভাবনা যা আমাদের ভয়, সন্দেহ, দুঃশ্চিন্তা বা হতাশা তৈরি করে। এসব ভাবনা সাধারণত “আমি পারব না”, “সবই খারাপ হবে” বা “আমি যথেষ্ট ভালো নই” এর মতো বাক্যের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এগুলো মনকে ভারী করে তোলে এবং আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়। ফলে আমরা স্বাভাবিক কাজও করতে ভয় পাই এবং আনন্দ হারিয়ে ফেলি।
নেতিবাচক চিন্তা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে মানসিক চাপ বাড়ে, ঘুমের সমস্যা হয় এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়। এর কারণে কাজের প্রতি আগ্রহ কমে যেতে পারে এবং সম্পর্কেও প্রভাব পড়ে। তাই নেতিবাচক চিন্তা চিহ্নিত করা এবং নিয়ন্ত্রণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে মন শান্ত থাকে এবং জীবন বেশি সুখী হয়।
প্রশ্ন–২। কীভাবে নেতিবাচক চিন্তা চেনা যায়?
নেতিবাচক চিন্তা সাধারণত সেই সময় আসে যখন আমরা কোনো পরিস্থিতিকে বাস্তবের তুলনায় বেশি ভয়ানক বা কঠিন মনে করি। যেমন—অল্প ভুল করলেই মনে হয় “আমি ব্যর্থ”, বা কেউ কিছু বললে মনে হয় “সে নিশ্চয়ই আমাকে অপছন্দ করে।” এই ধরনের বাড়াবাড়ি চিন্তা, ভয় বা সন্দেহ আসলেই বুঝতে হবে এটি নেতিবাচক ভাবনা। মনে খারাপ লাগা, উত্তেজনা, বা নিজের প্রতি রাগ—এগুলোও এমন চিন্তার সংকেত।
এগুলো চেনার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো নিজের অনুভূতিকে খেয়াল করা। যদি কোনো চিন্তা আপনাকে ভয়, চাপ বা দুঃখ দেয়, তাহলে থেমে সেই ভাবনাকে প্রশ্ন করুন—“এটা কি সত্য?” বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায়, চিন্তাটি বাস্তব নয়, বরং মনেই তৈরি। এই অনুশীলন করলে নেতিবাচক চিন্তা ধরা সহজ হয় এবং তার প্রভাবও কমে যায়।
প্রশ্ন–৩। নেতিবাচক চিন্তা কমানোর সহজ উপায় কী?
নেতিবাচক চিন্তা কমানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হলো চিন্তা থামানোর অভ্যাস তৈরি করা। যখনই মাথায় খারাপ বা ভয় তৈরি করা চিন্তা আসে, তখন সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বলুন—“থামো।” তারপর সেই চিন্তাকে বদলে দিন আরও বাস্তবসম্মত বা ইতিবাচক কথায়। যেমন—“আমি পারব না” ভাবলে সাথে সাথে বলুন, “আমি চেষ্টা করলে শিখতে পারব।” এতে মন দ্রুত শান্ত হয়।
আরেকটি কার্যকর উপায় হলো নিজের প্রতি দয়া দেখানো। ভুল হলে নিজেকে কঠোরভাবে না বলে বলুন, “ভুল হতেই পারে, এখন আবার চেষ্টা করব।” এভাবে ছোট ছোট কথায় নিজের মনকে অনুপ্রাণিত করলে নেতিবাচক চিন্তা ধীরে ধীরে কমে যায় এবং ইতিবাচক চিন্তা বাড়ে।
প্রশ্ন–৪। ইতিবাচক চিন্তা তৈরি করতে কৃতজ্ঞতার ভূমিকা কী?
কৃতজ্ঞতা হলো জীবনের ভালো জিনিসগুলোকে মান্য করা এবং তার জন্য ধন্যবাদ জানা। যখন আমরা প্রতিদিন কিছু ভালো জিনিসের জন্য কৃতজ্ঞ থাকি, তখন মন নেতিবাচক চিন্তা থেকে দূরে থাকে। যেমন—পরিবার, বন্ধু, সুস্বাস্থ্য বা শিক্ষার সুযোগের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে মন খুশি এবং শান্ত থাকে। এটি আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং চাপ কমায়।
একটি কার্যকর উপায় হলো প্রতিদিন কৃতজ্ঞতার তালিকা তৈরি করা। দিনে অন্তত ৩টি জিনিস লিখুন যেগুলোর জন্য আপনি ধন্য। ছোট শিশুদেরও এই অভ্যাস শেখানো যায়—যেমন “আজকে খাওয়ার জন্য ধন্যবাদ” বা “মা-বাবার জন্য ধন্যবাদ।” নিয়মিত চর্চায় এটি নেতিবাচক চিন্তাকে কমিয়ে ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলে।
প্রশ্ন–৫। নিজের সাথে ইতিবাচকভাবে কথা বলার মানে কী?
নিজের সাথে ইতিবাচকভাবে কথা বলা মানে হলো নিজের ভেতরের কণ্ঠকে বন্ধুর মতো ব্যবহার করা। নেতিবাচক চিন্তা যেমন “আমি পারব না” বা “সবই খারাপ হবে” পরিবর্তে নিজের সাথে বলুন—“আমি চেষ্টা করলে পারব” বা “আজকে চেষ্টা করেছি, এটা অনেক ভালো।” এটি মনকে শান্ত রাখে এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। নিজেকে উৎসাহ দেওয়াই ইতিবাচক কথা বলার মূল উদ্দেশ্য।
ছোট একটি কৌশল হলো ইতিবাচক বাক্য ব্যবহার করা। প্রতিদিন সকালে বা রাতে কিছু ইতিবাচক বাক্য বলুন—যেমন “আমি শক্তিশালী”, “আমি ভালো কিছু করতে পারি।” এই অনুশীলন ধীরে ধীরে মস্তিষ্ককে শেখায় নেতিবাচক চিন্তা কমাতে এবং ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখতে।
প্রশ্ন–৬। চারপাশের পরিবেশ কিভাবে মনকে প্রভাবিত করে?
আমাদের চারপাশের পরিবেশ আমাদের চিন্তা ও মনোভাবের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। যদি চারপাশে ঝগড়া, দুশ্চিন্তা বা নেতিবাচক মানুষ থাকে, মনও দ্রুত নেতিবাচক হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, শান্ত, পরিচ্ছন্ন এবং ইতিবাচক পরিবেশ মনকে সতেজ ও খুশি রাখে। তাই নিজের আশেপাশের পরিবেশকে ইতিবাচকভাবে সাজানো খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ছোট ছোট পরিবর্তনও বড় প্রভাব ফেলে। যেমন—ঘর পরিষ্কার রাখা, প্রিয় রঙের জিনিস রাখা, প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটানো বা ইতিবাচক মানুষের সঙ্গে থাকা। এই অভ্যাসগুলো আমাদের মস্তিষ্ককে ইতিবাচক সংকেত দেয় এবং নেতিবাচক চিন্তা কমায়। এমন পরিবেশে মন খোলামেলা, শান্ত এবং আনন্দময় থাকে।
প্রশ্ন–৭। দৈনন্দিন জীবনে আনন্দ ও বিশ্রামের গুরুত্ব কী?
দৈনন্দিন জীবনে আনন্দ এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম থাকা আমাদের মনকে ইতিবাচক রাখতে সাহায্য করে। যখন আমরা হালকা ব্যায়াম করি, প্রিয় কাজ করি বা প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাই, তখন মস্তিষ্ক “ফিল-গুড হরমোন” মুক্ত করে। এতে মন শান্ত থাকে, চাপ কমে এবং নেতিবাচক চিন্তা সহজে মাথায় আসে না। ছোট শিশুদেরও খেলাধুলা বা মজার কাজ মনকে খুশি করে।
ঘুমও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে মন খারাপ হয় এবং ছোট ঘটনা থেকেও বিরক্তি তৈরি হয়। দিনে অন্তত ৭–৮ ঘণ্টা ঘুম এবং রিল্যাক্সেশন কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করলে মস্তিষ্ক সতেজ থাকে। ফলে আমরা ইতিবাচকভাবে চিন্তা করতে পারি এবং জীবনের সমস্যার সঙ্গে সহজভাবে মোকাবিলা করতে পারি।
প্রশ্ন–৮। নেতিবাচক চিন্তা এড়াতে কি ধরণের মানুষদের সঙ্গে সময় কাটানো উচিত?
নেতিবাচক চিন্তা এড়াতে এমন মানুষের সঙ্গে সময় কাটানো উচিত যারা ইতিবাচক, উৎসাহিত এবং সহানুভূতিশীল। যারা সবসময় সমস্যা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বা অন্যকে ছোট করে, তাদের সঙ্গে বেশি সময় কাটানো মনকে নেতিবাচক করে তোলে। অন্যদিকে, যারা হাসে, সাহায্য করে এবং সমর্থন দেয়, তাদের সঙ্গে থাকা আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং মনকে ভালো রাখে।
শিশুদের জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বন্ধুদের মধ্যে যারা ভালো আচরণ, আনন্দ এবং খুশি ভাগাভাগি করে, তারা সহজে ইতিবাচক অভ্যাস শিখে। বড়রাও তাদের সামাজিক পরিবেশ মনমতো তৈরি করলে নেতিবাচক চিন্তা কম থাকে। অর্থাৎ, পরিবেশের মানুষই আমাদের চিন্তাভাবনায় বড় প্রভাব ফেলে।
প্রশ্ন–৯: নেতিবাচক চিন্তা এড়াতে ডিজিটাল ব্যবহার কেমন হওয়া উচিত?
ডিজিটাল প্রযুক্তি যেমন ফোন, ট্যাব বা কম্পিউটার আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ, কিন্তু যদি আমরা সব সময় নেতিবাচক খবর, ঝগড়ার ভিডিও বা হতাশাজনক মন্তব্য দেখি, মন খারাপ হতে পারে। তাই ডিজিটাল ব্যবহারে সচেতন হওয়া জরুরি। ইতিবাচক ও শিক্ষামূলক কনটেন্ট, হাস্যরস, প্রেরণাদায়ক গল্প বা প্রকৃতির ছবি দেখা মনকে খুশি রাখে।
ছোট শিশুদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ—তাদেরকে এমন কনটেন্ট দেখান যা মন ভালো রাখে। বড়রাও দৈনন্দিন সময়ের একটি অংশ ইতিবাচক ডিজিটাল অভ্যাসে ব্যয় করলে স্ট্রেস কমে এবং নেতিবাচক চিন্তা কমে। তাই ডিজিটাল ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণে রাখাই ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল।
প্রশ্ন–১০। নেতিবাচক চিন্তা দূর করার জন্য প্রতিদিনের ছোট অভ্যাসগুলো কি কাজে লাগে?
প্রতিদিনের ছোট ছোট অভ্যাস যেমন ধ্যান, শ্বাস-প্রশ্বাস অনুশীলন, হাঁটাহাঁটি, কৃতজ্ঞতার তালিকা লেখা এবং ইতিবাচক বাক্য বলা মনকে শক্তিশালী করে। এই অভ্যাসগুলো নেতিবাচক চিন্তা কমায় এবং মনের মধ্যে শান্তি ও ইতিবাচক শক্তি বজায় রাখে। ছোট শিশুরাও এই অভ্যাসগুলো অনুকরণ করতে পারে এবং ধীরে ধীরে ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলে।
ছোট অভ্যাসগুলো নিয়মিত চর্চা করলে মনে একটি স্থিতিশীলতা আসে। প্রতিদিনের রুটিনের অংশ হলে নেতিবাচক চিন্তা মাথায় কম আসে এবং আমরা সহজে চাপ মোকাবিলা করতে পারি। তাই ছোট ছোট ধাপগুলোই বড় প্রভাব ফেলে এবং দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখে।