আমাদের মস্তিষ্ককে অনেকটা একটি সুপার-কম্পিউটারের মতো ভাবা যায়, যেখানে অসংখ্য অংশ একসাথে কাজ করে আমাদের চিন্তা, অনুভূতি, স্মৃতি এবং শেখার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। এই বিশাল নেটওয়ার্কের একটি ছোট কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো হিপোক্যাম্পাস। নাম শুনে হয়তো মনে হবে এটি কোনো প্রাণীর অদ্ভুত অঙ্গ, কিন্তু আসলে এটি মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অঞ্চল, যা মূলত স্মৃতি সংরক্ষণ এবং শেখার প্রক্রিয়ায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
হিপোক্যাম্পাস দেখতে সামান্য বাঁকা, সি-আকৃতির (সি-শেপড) মতো, এবং এটি মস্তিষ্কের ভেতরে, টেম্পোরাল লোবের গভীরে অবস্থান করে। যদিও আকারে এটি বড় নয়, এর কাজ কিন্তু বিশাল। আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা, শেখা তথ্য, এমনকি জীবনের মূল্যবান স্মৃতিগুলোও এই ছোট অংশটির মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত হয় এবং সংরক্ষিত হয়। আপনি যখন কোনো নতুন বিষয় শিখছেন বা কোনো পুরনো ঘটনার কথা মনে করছেন, তখন আপনার হিপোক্যাম্পাসই কাজ করছে।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, হিপোক্যাম্পাস শুধু স্মৃতি তৈরি ও সংরক্ষণই করে না, বরং স্মৃতিকে সঠিক সময় ও স্থানের সঙ্গে সংযুক্ত করতেও সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি হয়তো মনে করতে পারবেন যে জন্মদিনের কেকটি কেমন স্বাদ ছিল, এবং সেই পার্টি কোথায় হয়েছিল। এই সময় এবং স্থান মনে রাখার ক্ষমতা হিপোক্যাম্পাস থেকেই আসে।
তবে হিপোক্যাম্পাস সবসময় একইভাবে কাজ করে না। আমাদের বয়স, জীবনযাপন, এমনকি মানসিক চাপও এর কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে। ভালো খবর হলো, বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে সঠিক অভ্যাস ও অনুশীলনের মাধ্যমে আমরা হিপোক্যাম্পাসকে সক্রিয় এবং সুস্থ রাখতে পারি।
এই নিবন্ধে আমরা ধাপে ধাপে জানবো—হিপোক্যাম্পাস আসলে কীভাবে কাজ করে, এটি আমাদের জীবনে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, এবং কীভাবে আমরা এর কার্যকারিতা বাড়াতে পারি। চলুন তাহলে প্রথম ধাপে যাই, যেখানে আমরা হিপোক্যাম্পাসের গঠন ও অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত জানবো।
১। হিপোক্যাম্পাসের গঠন ও অবস্থান
হিপোক্যাম্পাস শব্দটি এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে, যার অর্থ “সী-হর্স” বা সমুদ্রের ঘোড়া। নামটি এসেছে এর আকারের কারণে—এটি বাঁকা, লম্বাটে এবং সি-আকৃতির, যা দেখতে অনেকটা ছোট একটি সী-হর্সের মতো। এই অঙ্গটি আমাদের টেম্পোরাল লোব নামক মস্তিষ্কের এক বিশেষ অঞ্চলের গভীরে অবস্থিত। টেম্পোরাল লোব মূলত স্মৃতি, ভাষা বোঝা এবং অনুভূতির সঙ্গে জড়িত একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।
হিপোক্যাম্পাস মস্তিষ্কের দুই পাশেই থাকে—একটি বাম পাশে এবং আরেকটি ডান পাশে। এই দুটি হিপোক্যাম্পাস একসাথে কাজ করে, যেন একটি দল। যদি এক পাশ সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অন্য পাশ কিছুটা কাজ সামলাতে পারে, তবে গুরুতর ক্ষতি হলে স্মৃতি ও শেখার ক্ষমতায় বড় সমস্যা দেখা দেয়।
হিপোক্যাম্পাস মূলত তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত:
- ডেন্টেট গাইরাস (Dentate Gyrus) – এখানে নতুন নিউরন তৈরি হয়, যা নতুন স্মৃতি তৈরিতে সহায়তা করে।
- কর্নু অ্যামোনিস (Cornu Ammonis বা CA1, CA2, CA3) – এই অঞ্চলগুলো স্মৃতির তথ্য প্রক্রিয়াজাত করে এবং সংরক্ষণের জন্য প্রস্তুত করে।
- সাবিকুলাম (Subiculum) – এখানে প্রক্রিয়াজাত তথ্য মস্তিষ্কের অন্য অংশে পাঠানো হয়, যাতে দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিতে সংরক্ষণ সম্ভব হয়।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হিপোক্যাম্পাস শুধু তথ্য সংরক্ষণ করে না, বরং তথ্যকে সময় ও স্থান অনুযায়ী সাজিয়ে রাখতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি গত সপ্তাহে কোথায় বন্ধুদের সাথে দেখা করেছিলেন মনে করতে চান, তখন হিপোক্যাম্পাস সেই ঘটনার স্থান ও সময় মস্তিষ্কে মিলিয়ে আপনাকে মনে করিয়ে দেবে।
বিজ্ঞানীরা এমআরআই স্ক্যানের মাধ্যমে হিপোক্যাম্পাসকে বিস্তারিতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত মানসিক অনুশীলন (যেমন ধাঁধা সমাধান, নতুন ভাষা শেখা) করেন, তাদের হিপোক্যাম্পাস তুলনামূলকভাবে সক্রিয় ও সুস্থ থাকে।
এই গঠন ও অবস্থান সম্পর্কে ধারণা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখান থেকেই বোঝা যায় হিপোক্যাম্পাস কেন আমাদের শেখা ও মনে রাখার ক্ষমতার জন্য এত অপরিহার্য।
২। হিপোক্যাম্পাসের মূল কাজ ও ভূমিকা
হিপোক্যাম্পাসকে আপনি মস্তিষ্কের স্মৃতির লাইব্রেরিয়ান বলতে পারেন। এটি প্রতিদিন আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটে, সেগুলোর তথ্য সংগ্রহ করে, সাজিয়ে রাখে এবং প্রয়োজনের সময় মস্তিষ্কের “শেলফ” থেকে বের করে দেয়। এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো নতুন স্মৃতি তৈরি করা এবং সেই স্মৃতিকে দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণে সাহায্য করা।
১. নতুন স্মৃতি তৈরি করা
যখন আমরা নতুন কিছু শিখি—হোক সেটা একটি শব্দ, একটি গান, বা কোনো ঘটনা—তখন প্রথমে সেই তথ্য স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিতে যায়। হিপোক্যাম্পাস এই তথ্যগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে এবং দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিতে স্থানান্তর করে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি আজ যদি একটি নতুন ফোন নম্বর মুখস্থ করেন, হিপোক্যাম্পাস সেটিকে আপনার দীর্ঘমেয়াদি ডাটাবেসে পাঠাবে, যাতে কয়েক সপ্তাহ বা মাস পরে সেটি মনে করতে পারেন।
২. স্থান ও সময়ের সঙ্গে স্মৃতি সংযুক্ত করা
হিপোক্যাম্পাস শুধু তথ্য মনে রাখে না, বরং সেই তথ্যের সাথে সম্পর্কিত স্থান ও সময়ও সংরক্ষণ করে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি মনে করতে চান আপনার শেষ জন্মদিন কোথায় উদযাপন করেছিলেন, তখন হিপোক্যাম্পাস সেই ঘটনার স্থান, সময় এবং পরিবেশ একসাথে মনে করিয়ে দেবে।
৩. শেখার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করা
হিপোক্যাম্পাস আমাদের শেখার ক্ষমতার একটি মূল অংশ। আপনি যখন নতুন কিছু শিখছেন, তখন এটি পুরনো অভিজ্ঞতার সাথে নতুন তথ্য মেলাতে সাহায্য করে। যেমন, যদি আপনি নতুন কোনো রান্নার রেসিপি শিখছেন, হিপোক্যাম্পাস আগের রান্নার অভিজ্ঞতার সাথে নতুন তথ্যের মিল খুঁজে বের করে।
৪. দিক নির্দেশনা ও স্থানিক স্মৃতি (Spatial Memory)
হিপোক্যাম্পাস আমাদের চারপাশের মানচিত্র তৈরি করতেও সাহায্য করে। অর্থাৎ, এটি আপনাকে মনে রাখতে সাহায্য করে কোন রাস্তা দিয়ে স্কুলে বা অফিসে যেতে হয়। এই ক্ষমতাকেই বিজ্ঞানীরা বলেন Spatial Navigation।
৫. আবেগ ও স্মৃতির সংযোগ
আমরা যেসব স্মৃতি মনে রাখি, তার অনেকগুলোর সাথেই আবেগ জড়িত থাকে। যেমন, প্রথম পুরস্কার পাওয়ার আনন্দ বা দুর্ঘটনার ভয়। হিপোক্যাম্পাস আমাদের আবেগপ্রবণ স্মৃতিকে আরও শক্তিশালীভাবে সংরক্ষণ করে, যাতে সেগুলো সহজে ভুলে না যায়।
সারসংক্ষেপে বলা যায়, হিপোক্যাম্পাস হলো এমন একটি কেন্দ্র যেখানে শেখা, মনে রাখা, দিকনির্দেশনা ও আবেগ—সবই একত্রে কাজ করে। এই কারণে এটি ছাড়া আমাদের স্মৃতি ব্যবস্থা কার্যত অচল হয়ে পড়বে।
৩। হিপোক্যাম্পাস কীভাবে স্মৃতি সংরক্ষণ করে
হিপোক্যাম্পাসের কাজ অনেকটা একটি তথ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মতো। প্রতিদিন আমাদের চোখ, কান, নাক, জিভ এবং ত্বক থেকে অসংখ্য তথ্য মস্তিষ্কে পৌঁছায়। কিন্তু সব তথ্যই আমাদের দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিতে যায় না। হিপোক্যাম্পাসের বিশেষ ভূমিকা হলো কোন তথ্য রাখা হবে আর কোনটি বাদ দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করা।
১. তথ্য গ্রহণ ও বাছাই
যখন আমরা নতুন কিছু দেখি, শুনি বা অনুভব করি, তখন সেই তথ্য প্রথমে স্বল্পমেয়াদি স্মৃতিতে জমা হয়। হিপোক্যাম্পাস এই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে দেখে কোনগুলো গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো পরে দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিতে স্থানান্তরিত হয়, বাকিগুলো বাদ পড়ে যায়।
উদাহরণস্বরূপ, আপনি হয়তো গত সপ্তাহে সকালের নাশতায় কী খেয়েছিলেন ভুলে গেছেন, কিন্তু পরীক্ষার প্রস্তুতির সময় শেখা একটি সূত্র এখনো মনে আছে—এটাই হিপোক্যাম্পাসের বাছাই প্রক্রিয়া।
২. তথ্য স্থানান্তর (Encoding)
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হিপোক্যাম্পাস থেকে মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশে পাঠানো হয়, বিশেষ করে Neocortex-এ। সেখানেই দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতি হিসেবে তথ্য সংরক্ষিত থাকে। এটা অনেকটা বইয়ের লাইব্রেরিতে স্থায়ীভাবে রাখা ফাইলের মতো।
৩. স্মৃতি পুনরুদ্ধার (Retrieval)
যখন আমরা কোনো পুরনো তথ্য মনে করতে চাই, হিপোক্যাম্পাস সেই তথ্যের “অবস্থান” খুঁজে বের করে এবং তা সক্রিয় করে তোলে। যেমন, আপনি যদি আপনার প্রথম স্কুলের নাম মনে করতে চান, হিপোক্যাম্পাস সেই তথ্যের দরজা খুলে দেয়।
৪. সংযোগ তৈরি (Association)
হিপোক্যাম্পাস শুধু তথ্য সংরক্ষণ করে না, বরং তথ্যগুলোর মধ্যে সংযোগও তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, “গরম চা” শব্দ শুনলেই যদি আপনার মায়ের সাথে শীতের সকালে কাটানো মুহূর্ত মনে পড়ে, সেটি হিপোক্যাম্পাসের কাজ।
৫. নতুন নিউরন তৈরি (Neurogenesis)
গবেষণায় দেখা গেছে, হিপোক্যাম্পাস জীবনের পুরো সময় ধরে নতুন নিউরন তৈরি করতে সক্ষম—বিশেষ করে Dentate Gyrus অংশে। নতুন নিউরন তৈরি হলে স্মৃতি গঠনের ক্ষমতাও বাড়ে।
স্মৃতি সংরক্ষণের এই জটিল প্রক্রিয়ায় হিপোক্যাম্পাস অনেকটা ডেটা ম্যানেজারের মতো কাজ করে—তথ্য সংগ্রহ, বাছাই, সংরক্ষণ এবং প্রয়োজন হলে ফিরিয়ে দেওয়া—সব কিছুই দক্ষতার সাথে পরিচালনা করে।
৪। হিপোক্যাম্পাসের ক্ষতি হলে কী হয়
হিপোক্যাম্পাস আমাদের স্মৃতি ও শেখার জন্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে জীবনে বড় পরিবর্তন আসতে পারে। ক্ষতির মাত্রা ও অবস্থান অনুযায়ী এর প্রভাব ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি স্মৃতিশক্তি ও দিকনির্দেশনার ক্ষমতায় গুরুতর প্রভাব ফেলে।
১. অ্যান্টেরোগ্রেড অ্যামনেশিয়া (Anterograde Amnesia)
এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে নতুন স্মৃতি তৈরি করার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। অর্থাৎ, আপনি পুরনো ঘটনা মনে রাখতে পারেন, কিন্তু নতুন শেখা বা ঘটনার তথ্য কয়েক মিনিটের মধ্যে ভুলে যান। উদাহরণস্বরূপ, আপনি আজ নতুন এক বন্ধুর সাথে পরিচিত হলেন, কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর তার নাম মনে করতে পারবেন না।
২. রেট্রোগ্রেড অ্যামনেশিয়া (Retrograde Amnesia)
এক্ষেত্রে পুরনো স্মৃতিগুলো ধীরে ধীরে মুছে যেতে শুরু করে, বিশেষ করে ক্ষতির আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। যেমন, দুর্ঘটনার আগে জীবনের কিছু স্মৃতি ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলা।
৩. দিকনির্দেশনা হারানো (Spatial Disorientation)
হিপোক্যাম্পাস স্থানিক স্মৃতি বা “মনের মানচিত্র” তৈরি করে। এটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরিচিত জায়গায়ও মানুষ পথ হারিয়ে ফেলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নিজের বাড়ির কাছাকাছি রাস্তা থেকেও সঠিক পথ চিনতে না পারা।
৪. শেখার ক্ষমতা কমে যাওয়া
হিপোক্যাম্পাস ক্ষতিগ্রস্ত হলে নতুন ভাষা শেখা, নতুন দক্ষতা অর্জন, এমনকি সাধারণ তথ্য মুখস্থ করাও কঠিন হয়ে যায়। শিক্ষার্থী বা পেশাজীবীদের জন্য এটি বিশেষভাবে ক্ষতিকর।
৫. আবেগীয় পরিবর্তন
স্মৃতির সাথে আবেগের গভীর সম্পর্ক আছে, এবং হিপোক্যাম্পাসের ক্ষতি হলে মানুষের আবেগের প্রতিক্রিয়া বদলে যেতে পারে। কিছু মানুষ অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে, আবার কেউ কেউ ঘটনার সাথে আবেগ জুড়তে অক্ষম হয়ে পড়ে।
৬. কারণসমূহ
হিপোক্যাম্পাস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে—মস্তিষ্কে আঘাত, স্ট্রোক, দীর্ঘমেয়াদি অক্সিজেনের ঘাটতি, মস্তিষ্কে সংক্রমণ, অথবা আলঝেইমারস রোগ। এছাড়াও দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেস ও ডিপ্রেশনও হিপোক্যাম্পাসের গঠনকে দুর্বল করে দিতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, একবার হিপোক্যাম্পাস গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা সম্পূর্ণরূপে ঠিক করা কঠিন, তবে কিছু ক্ষেত্রে নিয়মিত মানসিক ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং চিকিৎসা পদ্ধতি স্মৃতিশক্তি কিছুটা উন্নত করতে পারে।
৫। হিপোক্যাম্পাস সুস্থ রাখার উপায়
হিপোক্যাম্পাস যদিও বয়স, রোগ বা মানসিক চাপের কারণে দুর্বল হতে পারে, তবুও বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে কিছু সহজ জীবনধারা ও অভ্যাস এটি দীর্ঘ সময় সক্রিয় ও সুস্থ রাখতে সাহায্য করতে পারে। সুস্থ হিপোক্যাম্পাস মানে ভালো স্মৃতি, দ্রুত শেখার ক্ষমতা এবং মনোযোগ ধরে রাখার দক্ষতা।
১. মানসিক ব্যায়াম করুন
যেমন শরীরচর্চা পেশিকে শক্তিশালী করে, তেমনি মস্তিষ্কেরও ব্যায়াম দরকার। ধাঁধা সমাধান, শব্দ খেলা, নতুন ভাষা শেখা বা বই পড়া হিপোক্যাম্পাসকে উদ্দীপিত করে। প্রতিদিন অন্তত কিছু সময় মানসিক চ্যালেঞ্জিং কাজে ব্যয় করলে নিউরনের সংযোগ মজবুত হয়।
২. শারীরিক ব্যায়াম করুন
গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ব্যায়াম—বিশেষ করে হাঁটা, দৌড়ানো বা সাইকেল চালানো—হিপোক্যাম্পাসে নতুন নিউরন তৈরিতে সহায়তা করে (Neurogenesis)। ব্যায়াম রক্তসঞ্চালন বাড়ায়, যা মস্তিষ্কে অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছায়।
৩. গুণগত ঘুম নিশ্চিত করুন
হিপোক্যাম্পাস ঘুমের সময় দিনের তথ্যগুলো প্রক্রিয়াজাত করে এবং দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিতে সংরক্ষণ করে। পর্যাপ্ত ও গভীর ঘুম না হলে নতুন স্মৃতি গঠনে সমস্যা হয়। তাই প্রতিদিন অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ভালো ঘুম অপরিহার্য।
৪. স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করুন
দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ হিপোক্যাম্পাসের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। মেডিটেশন, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, প্রিয় কাজ করা এবং পরিবারের সাথে সময় কাটানো স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে।
৫. সুস্থ খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার (যেমন মাছ, বাদাম), তাজা শাকসবজি, ফল এবং পর্যাপ্ত পানি মস্তিষ্কের জন্য উপকারী। অতিরিক্ত চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এগুলো মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে।
৬. নতুন অভিজ্ঞতা নিন
মস্তিষ্ক নতুন কিছু শিখলে এবং নতুন জায়গা দেখলে উদ্দীপিত হয়। ভ্রমণ, নতুন শখ শুরু করা, ভিন্ন সংস্কৃতি জানা—এসব হিপোক্যাম্পাসকে সক্রিয় রাখে।
৭. সামাজিক যোগাযোগ বজায় রাখুন
বন্ধু ও পরিবারের সাথে কথা বলা, একসাথে কাজ করা এবং অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করা মানসিকভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতে সাহায্য করে।
সারকথা, হিপোক্যাম্পাসের যত্ন নেওয়া মানে মস্তিষ্কের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া। সঠিক অভ্যাস ও ইতিবাচক জীবনধারা অবলম্বন করলে বয়স বাড়লেও মস্তিষ্ক অনেকটা তরুণ ও কার্যকর রাখা সম্ভব।
উপসংহার: মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসের গুরুত্ব
হিপোক্যাম্পাস আমাদের মস্তিষ্কের একটি ছোট কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী অংশ, যা প্রতিদিন নীরবে আমাদের শেখা, মনে রাখা এবং দিকনির্দেশনার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো পরিচালনা করে। এটি নতুন স্মৃতি তৈরি, পুরনো স্মৃতি পুনরুদ্ধার এবং তথ্যের সাথে স্থান ও সময়ের সংযোগ তৈরি করতে প্রধান ভূমিকা পালন করে।
এই অংশটি সুস্থ থাকলে আমরা সহজে নতুন কিছু শিখতে পারি, অভিজ্ঞতা মনে রাখতে পারি এবং দৈনন্দিন জীবনে আত্মবিশ্বাসের সাথে চলতে পারি। কিন্তু হিপোক্যাম্পাস ক্ষতিগ্রস্ত হলে স্মৃতি দুর্বল হয়ে যায়, শেখার ক্ষমতা কমে যায় এবং এমনকি পরিচিত জায়গায়ও পথ হারানোর মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
সুখবর হলো, সঠিক অভ্যাস ও যত্নের মাধ্যমে আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে দীর্ঘ সময় সক্রিয় ও কার্যকর রাখতে পারি। মানসিক ও শারীরিক ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম, স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্যকর খাদ্য এবং সামাজিক মেলামেশা—সবই হিপোক্যাম্পাসের জন্য উপকারী।
শেষ কথা, মস্তিষ্কের এই ক্ষুদ্র অংশটি আসলে আমাদের পুরো জীবনের স্মৃতি ও শেখার ক্ষমতার ভিত্তি। তাই হিপোক্যাম্পাসের যত্ন নেওয়া মানে নিজের ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃঢ় মানসিক ভিত্তি গড়ে তোলা।