দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য ৫টি সহজ করণীয়

Spread the love

সব শিক্ষার্থী এক ধরনের নয়। কারো পড়াশোনা ভালো চলে, আবার কারো একটু পিছিয়ে পড়ে যেতে পারে। বিশেষ করে যারা পড়াশোনায় দুর্বল, তাদের জন্য একটু বেশি সাহায্য এবং যত্নের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দুর্বল হওয়া মানে হতাশ হওয়া নয়। বরং এটা একটা সুযোগ, যেখান থেকে ধাপে ধাপে নিজেকে উন্নত করা সম্ভব। এই লেখায় আমরা জানব দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য কী কী করণীয়, যাতে তারা আত্মবিশ্বাসে ভরে উঠে এবং ভালো ফলাফল করতে পারে।

১ । দুর্বল শিক্ষার্থীদের চ্যালেঞ্জগুলো বুঝে নেওয়া

সব ছাত্র-ছাত্রীর পড়াশোনার ক্ষমতা একরকম হয় না। অনেক সময় কিছু শিক্ষার্থী অন্যদের তুলনায় পড়াশোনায় একটু পিছিয়ে পড়ে যায়। এরা হল ‘দুর্বল শিক্ষার্থী’। কিন্তু দুর্বল হওয়া মানেই দুর্বল থাকা নয়। আসলে দুর্বল হওয়ার কারণ বুঝলেই আমরা তাদের উন্নতির পথ খুঁজে পেতে পারি।

দুর্বল শিক্ষার্থীরা সাধারণত যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়, সেগুলো হল — মনোযোগ কম থাকা, বইয়ের বিষয়বস্তু বোঝা কঠিন হওয়া, পরীক্ষা নিয়ে উদ্বেগ, বা পরিবারের ও পরিবেশের অসুবিধা। তাই প্রথমে আমরা এই সমস্যাগুলোকে ভালো করে চিনে নিতে হবে।

একজন শিক্ষক বা অভিভাবক হিসেবে, আপনাকে প্রথমে বুঝতে হবে শিক্ষার্থী কোথায় পিছিয়ে পড়েছে। হয়তো তিনি কোন বিষয় ভালো বুঝতে পারেন না, অথবা মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না। মাঝে মাঝে মানসিক চাপ বা আত্মবিশ্বাসের অভাবও দুর্বলতার বড় কারণ হতে পারে। তাই ধৈর্য ধরে তাকে কথা বলতে দিন, তার সমস্যাগুলো শোনার চেষ্টা করুন। এতে সে বোঝবে, কেউ তার পাশে আছেন।

দুর্বল শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় চাহিদা হলো ভালো সহায়তা এবং সঠিক দিকনির্দেশনা। তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে, ‘তুমি পারবে, যদি সঠিকভাবে চেষ্টা করো।’ এর পাশাপাশি, ছোট ছোট ধাপে শেখানো বা পড়ার পদ্ধতি নিতে হবে যাতে তারা একসঙ্গে অনেক কিছু শিখতে না হয়। ছোট ছোট লক্ষ্যে ফোকাস করলে, তাদের কাছে কাজটি সহজ মনে হবে।

আমাদের প্রথম কাজ হলো তাদের দুর্বলতা বুঝে নেওয়া এবং তাদের জন্য ধৈর্যশীল, সহজ ও স্নেহপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা। তখনই তারা উন্নতির পথে যেতে পারবে।

২ । সময় ও পরিকল্পনা ঠিক করা

যখন আমরা বুঝে নিই একজন ছাত্র দুর্বল, তখন পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সঠিক সময় ও পরিকল্পনা তৈরি করা। পড়াশোনা করতে গেলে সময়ের সঠিক ব্যবহার খুব জরুরি। অনেক সময় দুর্বল শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার সময় ঠিকমতো ভাগ করতে পারে না, অথবা একসঙ্গে অনেকক্ষণ পড়ার চেষ্টা করে যা তাদের জন্য বোঝা ভারী হয়ে ওঠে।

প্রথমেই বলা উচিত, ছোট ছোট ভাগে পড়াশোনা করা। যেমন, ২৫ থেকে ৩০ মিনিট পড়ার পর ৫-১০ মিনিট বিশ্রাম নেওয়া। এটা তাদের মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে। একবারে অনেকক্ষণ পড়ার চেয়ে ছোট ছোট সময়ে নিয়মিত পড়া বেশি ফলপ্রসূ হয়।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পরিকল্পনা করা। প্রতিদিনের জন্য ছোট একটা তালিকা তৈরি করুন — আজ কোন বিষয়গুলো পড়বেন, কতক্ষণ পড়বেন, কোন বিষয় বেশি মনোযোগের প্রয়োজন ইত্যাদি। এর ফলে দুর্বল শিক্ষার্থী পড়াশোনায় মনোযোগ ধরে রাখতে পারে এবং বুঝতে পারে কতটুকু কাজ শেষ হয়েছে।

অন্যদিকে, পরিকল্পনায় অবশ্যই ‘বিরতি’ বা ‘আনন্দের সময়’ রাখুন। অনেক সময় পড়াশোনার চাপের কারণে শিশু হতাশ হয়ে পড়ে। তাই খেলাধুলা, গান শোনা, বই পড়া বা পরিবারের সঙ্গে কথা বলা ইত্যাদি কিছু আনন্দময় কাজও সময়সূচিতে রাখা উচিত। এতে মন সতেজ থাকে এবং পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ে।

একজন অভিভাবক বা শিক্ষক হিসেবে, সময়সূচি তৈরিতে সাহায্য করুন এবং নিয়মিত সেটা দেখুন। এভাবে দুর্বল শিক্ষার্থী ধীরে ধীরে নিয়ম মেনে চলার অভ্যাস গড়ে তুলবে, যা তার মেধা উন্নতিতে বড় ভূমিকা রাখবে।

অবশেষে, সময় ও পরিকল্পনা ঠিক করা মানে শুধু পড়াশোনার জন্য নয়, পুরো জীবনের সঠিক ব্যবস্থাপনাও শেখানো। এতে সে পরবর্তী জীবনে আরও সাফল্য অর্জন করতে পারবে।

৩।  পড়াশোনার জন্য সঠিক পদ্ধতি গ্রহণ

দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য শুধুমাত্র পড়ার সময় বাড়ানো যথেষ্ট নয়, বরং সঠিক পদ্ধতিতেই পড়াশোনা করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় পড়াশোনা হয়তো হয়, কিন্তু ভুল পদ্ধতির কারণে মনোযোগ কমে যায় বা তথ্য মনে থাকে না।

প্রথমেই বলতে হবে, সক্রিয় পড়াশোনা করতে হবে। অর্থাৎ শুধু বই পড়ে যাওয়া নয়, পড়ার সময় বুঝে বোঝে চিন্তা করা। কোন অংশটি ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে না সেটা চিহ্নিত করা এবং আবার সেটি পড়া। পড়ার পর নিজের শব্দে বিষয়টি মনে করিয়ে নেওয়া বা ছোট ছোট নোট তৈরি করা খুব কার্যকরী।

দ্বিতীয়ত, প্রশ্ন করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। যদি কোনো বিষয় বুঝতে অসুবিধা হয়, তবে শিক্ষক বা অভিভাবকের কাছে জিজ্ঞাসা করুন। নিজের সন্দেহ স্পষ্ট করলে মনে থাকে এবং মেধা বাড়ে। কেউ কিছু বুঝাতে না পারলেও হার মানবেন না, যতবার দরকার আবার চেষ্টা করুন।

তৃতীয়ত, পড়াশোনার পরিবেশ ঠিক রাখা জরুরি। শান্ত ও পরিষ্কার একটি জায়গায় বসে পড়া উচিত। মোবাইল ফোন বা টিভির মতো বিভ্রান্তি দূর রেখে মনোযোগ ধরে রাখতে হবে। অনেক দুর্বল শিক্ষার্থী পারফেক্ট পরিবেশ না পেলে পড়াশোনা থেকে মন সরিয়ে নেয়, যা ভালো নয়।

চতুর্থত, পড়াশোনার ক্ষেত্রে স্মৃতি শক্তি বাড়ানোর কৌশল যেমন—মনে রাখার জন্য গল্প বানানো, চিত্র আঁকা বা কোন বিষয়ের সাথে নিজের জীবনের বাস্তব ঘটনা যোগ করা খুবই কার্যকর। এতে বিষয়গুলো মস্তিষ্কে ভালোভাবে জমে থাকে।

সবশেষে, নিয়মিত সময় নিয়ে পড়াশোনা করাই সেরা পদ্ধতি। অনেক দুর্বল ছাত্র পড়াশোনার জন্য অপেক্ষাকৃত কম সময় দেন, আর সেই সময়টাও হয়তো অনিয়মিত। তাই ছোট ছোট ভাগে কিন্তু প্রতিদিন পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

৪ । আত্মবিশ্বাস বাড়ানো ও অনুপ্রেরণা দেওয়া

একজন দুর্বল শিক্ষার্থীর সবচেয়ে বড় বাধা হলো নিজেকে নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব। অনেক সময় তারা নিজেকে ছোট করে দেখে, মনে করে “আমি পারব না,” “আমার কি করার আছে?” এই মনোভাব তাদের মেধা বিকাশের পথে বড় বাঁধা।

এই কারণে, তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হয়। একজন অভিভাবক বা শিক্ষক যদি তাদের ছোট ছোট সাফল্যের জন্য উৎসাহ দেয়, প্রশংসা করে, তাহলে তারা আরও মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে আগ্রহী হয়।

তাদের ছোট ছোট অর্জন উদযাপন করা উচিত। যেমন—একটি বিষয় ভালোভাবে বুঝলে, ছোট্ট একটি পুরস্কার বা শুভেচ্ছা জানানো যেতে পারে। এতে তারা বুঝবে, চেষ্টা করলে ফল মেলে এবং ভালো হওয়া সম্ভব।

অনুপ্রেরণামূলক গল্প বা বক্তব্য তাদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী, খেলোয়াড় কিংবা আমাদের চারপাশের কেউ যারা আগে দুর্বল ছিল কিন্তু পরবর্তীতে সফল হয়েছে, তাদের গল্প শুনানো যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থী বুঝতে পারে যে, কষ্ট আর ধৈর্য থাকলে সবাই উন্নতি করতে পারে।

আরেকটি খুব জরুরি ব্যাপার হলো হতাশা দূর করা। কেউ যদি পড়াশোনায় ভালো না পারে, তবে তাকে কখনো তিরস্কার বা হেয় না করা উচিত। বরং বুঝিয়ে বলা উচিত, “ভুল হওয়া স্বাভাবিক, চেষ্টা করলে ভালো হবে।”

একটু বেশি ধৈর্য ও ভালোবাসা দেখালে দুর্বল শিক্ষার্থী ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়, যা তার পড়াশোনার ক্ষেত্রে বড় প্লাস পয়েন্ট।

৫ । অভিভাবক ও শিক্ষকদের সহযোগিতা ও পরিবেশ তৈরি

দুর্বল শিক্ষার্থীদের উন্নতির জন্য সবচেয়ে বড় সাহায্য আসে ভালো পরিবার ও বিদ্যালয় পরিবেশ থেকে। অভিভাবকরা যদি সন্তানদের পাশে থেকে তাদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে, ধৈর্য ধারণ করে এবং সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়, তাহলে শিশুরা অনেক সহজেই পিছিয়ে পড়া থেকে উন্নতির দিকে যেতে পারে।

পরিবারের সকল সদস্যের উচিত ছাত্রের প্রতি ভালবাসা ও সমর্থন দেখানো। গৃহকর্মের চাপ কমিয়ে শিশুর পড়াশোনার জন্য সময় দেওয়া, প্রয়োজনমত সাহায্য করা, এবং উৎসাহ জোগানো খুব জরুরি। এছাড়া, অভিভাবকরা নিয়মিত শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন, যাতে শিশুর পড়াশোনা ও আচরণের বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায় এবং প্রয়োজনে সাহায্যের ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

বিদ্যালয়েও শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকরা যদি ধৈর্যশীল ও সহানুভূতিশীল হয়ে দুর্বল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশেষ মনোযোগ দিয়ে কাজ করেন, তাদের বোঝাতে সহজ পদ্ধতি ব্যবহার করেন, তাহলে শিক্ষার্থীরা বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়। কেবল পড়াশোনা নয়, ভালো মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশও তাদের উন্নতির জন্য দরকার।

একটি শান্ত, মনোযোগী ও উৎসাহ ব্যঞ্জক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে যেখানে শিশুরা ভুল করতে ভয় পায় না, বরং ভুল থেকে শিখতে উৎসাহ পায়। এতে করে তারা নিজেকে উন্নত করতে উৎসাহী হয়।

অবশেষে, পরিবার ও বিদ্যালয় মিলেমিশে কাজ করলে দুর্বল শিক্ষার্থীরা তাদের মেধা বিকাশে অনায়াসে এগিয়ে যেতে পারে।

উপসংহার

দুর্বল শিক্ষার্থী হওয়া কোনো শেষ কথা নয়। সঠিক পরিকল্পনা, ধৈর্য, ভালো পদ্ধতি এবং আশেপাশের মানুষের সহযোগিতায় তারা ধীরে ধীরে মেধাবী হয়ে উঠতে পারে। সবচেয়ে জরুরি হলো তাদের প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বাস রাখা, কারণ প্রত্যেক মানুষের মধ্যে কিছু না কিছু সম্ভাবনা থাকে। তাই আমাদের সবাইকে এগিয়ে এসে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, যেন তারা নিজের সেরাটা দিতে পারে এবং জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারে।

Leave a Comment

You cannot copy content of this page