অনিয়মিত ওষুধ গ্রহণ কিভাবে মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্য নষ্ট করে?  

Spread the love

আমরা অনেক সময় অসুস্থ হলে ওষুধ খাই, কিন্তু নিয়মিত ও ঠিকমতো খাওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখি না। ওষুধ যদি কখনো খাই, কখনো ভুলে যাই, আবার কখনো চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ডোজ কম–বেশি করি—তাহলে আমাদের শরীরের ভেতরে থাকা গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিকগুলো এলোমেলো হয়ে যেতে পারে।

বিশেষ করে মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্য খুব দ্রুত নষ্ট হয়। মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করার জন্য কিছু নির্দিষ্ট রাসায়নিকের সঠিক মাত্রা দরকার হয়। অনিয়মিত ওষুধ গ্রহণ সেই ভারসাম্য বিঘ্নিত করে মন-মেজাজ, স্মৃতি, ঘুম এবং শারীরিক অনুভূতিতে সমস্যা তৈরি করতে পারে। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়মতো জানা দরকার।

১। মস্তিষ্কের রাসায়নিক কী এবং কেন এগুলো এত গুরুত্বপূর্ণ?

আমাদের মস্তিষ্ককে যদি একটি বড় ব্যস্ত শহর ধরি, তবে তার ভেতরে লাখ লাখ ছোট বার্তাবাহক দিন–রাত দৌড়াদৌড়ি করছে। এই বার্তাবাহকদের আমরা বলি রাসায়নিক বা নিউরোট্রান্সমিটার। এরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমাদের কথা বলা, হাসা, মন খারাপ হওয়া, ঘুম আসা, পড়াশোনা করা—সবকিছুই এরা নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন শহরে যদি ট্রাফিক ঠিক না থাকে, গাড়ি জ্যামে আটকে যায়, মানুষ ঠিকমতো চলতে পারে না—মস্তিষ্কেও একই অবস্থা হয় যখন রাসায়নিক ভারসাম্য নষ্ট হয়।

মস্তিষ্কের রাসায়নিক এবং তাদের গুরুত্ব বোঝানো একটি চিত্র, যেখানে নিউরোট্রান্সমিটার বা মেসেঞ্জার দেখানো হয়েছে।
মস্তিষ্কের রাসায়নিক, মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য, সেরোটোনিন, ডোপামিন, মনোবিজ্ঞান

এই রাসায়নিকগুলোর মধ্যে কিছু খুব পরিচিত—যেমন সেরোটোনিন (মুড ভালো রাখে), ডোপামিন (উৎসাহ বাড়ায়), নরএপিনেফ্রিন (মনোযোগ ঠিক রাখে)। এগুলো খুব নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকলে মস্তিষ্ক শান্তভাবে কাজ করে। কিন্তু মাত্রা কমে গেলে বা বেড়ে গেলে শরীর ও মনের উপর খারাপ প্রভাব পড়ে।

এখন ভাবুন, ডাক্তার যখন কোনো ওষুধ দেন, তিনি জানেন এই রাসায়নিকগুলোর উপর কতটা প্রভাব পড়বে। ওষুধের ডোজ, সময়, এবং কতদিন চলবে—এসবই ঠিক করা থাকে যাতে মস্তিষ্কের রাসায়নিকগুলো সঠিকভাবে সামঞ্জস্য থাকে। কিন্তু আমরা যদি ওষুধ অনিয়মিতভাবে খাই—কখনো খাই, কখনো ভুলে যাই, আবার কখনো নিজের ইচ্ছায় কম–বেশি করি—তাহলে এই বার্তাবাহকদের কাজ এলোমেলো হয়ে যায়। এতে মস্তিষ্কে ভুল সংকেত যেতে শুরু করে।

একটা ছোট উদাহরণ:
ধরুন আপনি প্রতিদিন ১টা করে ওষুধ খেতে হবে, যেটা সেরোটোনিনকে স্থির রাখতে সাহায্য করে। আপনি যদি মাঝে মাঝে ওষুধ না খান, সেরোটোনিন হঠাৎ কমে যেতে পারে। আবার পরের দিন খেলে সেটা হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে। এই ওঠানামা আপনার মন-মেজাজ পুরো গুলিয়ে দেবে। ফলে আপনি কখনো অকারণে মন খারাপ অনুভব করবেন, কখনো অতিরিক্ত চিন্তায় ভুগবেন, আবার কখনো পুরোই অস্থির হয়ে উঠবেন।

এভাবে ধারাবাহিকভাবে রাসায়নিকদের কাজ বাধাগ্রস্ত হলে মস্তিষ্ক সঠিকভাবে বার্তা পাঠাতে পারে না। এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আরও খারাপ হতে পারে—ঘুম নষ্ট, মনোযোগ কমে যাওয়া, ভুলে যাওয়া বেড়ে যাওয়া অথবা আচরণে পরিবর্তন আসা।

অর্থাৎ, মস্তিষ্কের রাসায়নিকগুলো খুবই কোমল এবং নিয়মমাফিক যত্ন চায়। অনিয়মিত ওষুধ এগুলোর কাজের “টাইমটেবিল” নষ্ট করে দেয়।

২। অনিয়মিত ওষুধ গ্রহণ করলে মস্তিষ্কের সংকেত পাঠানোর ক্ষমতা কীভাবে বিঘ্নিত হয়

আমাদের মস্তিষ্ককে আপনি একটি বড় “তথ্যকেন্দ্র” ভাবতে পারেন। এই কেন্দ্র প্রতিদিন কোটি কোটি বার্তা শরীরের বিভিন্ন অংশে পাঠায়—যেমন কখন ঘুমাবে, কখন খাবে, কোন কাজটায় মনোযোগ দেবে, এমনকি কীভাবে অনুভব করবে। এসব বার্তা পাঠানোর জন্য মস্তিষ্ক ব্যবহার করে ছোট ছোট রাসায়নিক সংকেত। ঠিক যেমন মোবাইল ফোনে সিগন্যাল না থাকলে কল কাটা যায় বা ভাঙা ভাঙা শোনা যায়, ঠিক তেমনি অনিয়মিত ওষুধ খেলে মস্তিষ্কের অন্তর্গত সিগন্যালও গোলমাল হয়ে যায়।

একজন ব্যক্তি শয্যায় শুয়ে আছে, পাশে ওষুধের বোতল রাখা, যা অনিয়মিত ওষুধ গ্রহণে মস্তিষ্কের সংকেতের বিঘ্ন প্রকাশ করছে।
একজন ব্যক্তি শয্যায় শুয়ে আছে, পাশে ওষুধের বোতল রাখা, যা অনিয়মিত ওষুধ গ্রহণে মস্তিষ্কের সংকেতের বিঘ্ন প্রকাশ করছে।

যখন ডাক্তার ওষুধ দেন, সেই ওষুধের কাজ হলো মস্তিষ্কের রাসাযনিক ভারসাম্য ঠিক রাখতে সাহায্য করা। যেমন কিছু ওষুধ সেরোটোনিন বাড়ায়, কিছু ডোপামিন নিয়ন্ত্রণ করে, আবার কিছু ওষুধ মস্তিষ্ককে শান্ত করতে সাহায্য করে। কিন্তু আমরা যদি সেই ওষুধ নিয়মমাফিক না খাই—কখনো খাই, কখনো ভুলে যাই—তাহলে মস্তিষ্কের ভেতরের “সিগন্যাল পাঠানোর লাইন”ে ওঠানামা শুরু হয়।

ধরুন, মস্তিষ্ক একটি বার্তা পাঠাল — “এখন শান্ত হও, ঘুম আসুক।”
কিন্তু আপনি যেই ওষুধটি ঘুমের রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ করে সেটি দুই দিন খাননি। ফলে সেই রাসায়নিক কমে যাচ্ছে। এতে মস্তিষ্ক চেষ্টা করলেও ঠিকভাবে বার্তা পৌঁছাতে পারে না। ফল—ঘুম আসে না, মাথা অস্থির লাগে।

আবার আরেকটি উদাহরণ:
ধরুন আপনি একটি মানসিক চাপ কমানোর ওষুধ খাচ্ছেন। ওষুধটি প্রতিদিন খাওয়া দরকার যাতে মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে চাপ কমাতে পারে। কিন্তু আপনি কয়েকদিন ওষুধ ভুলে গেলেন। এতে মস্তিষ্কের “চাপ নিয়ন্ত্রণকারী” রাসায়নিক কমে যায়। যখন আপনি হঠাৎ আবার ওষুধ খাওয়া শুরু করেন, তখন রাসায়নিক হঠাৎ বেড়ে যায়। এই ওঠানামা মস্তিষ্ককে বিভ্রান্ত করে ফেলে। ফলে সংকেত ঠিক সময়ে ঠিক মাত্রায় পাঠানো যায় না।

এই বিঘ্নের কারণে—

  • মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়
  • অকারণে ভয় বা দুশ্চিন্তা আসে
  • মন-মেজাজ দ্রুত বদলে যায়
  • মাথা ঝিমঝিম করে বা ক্লান্ত লাগে
  • শরীর হঠাৎ অস্বস্তি অনুভব করে

সব মিলিয়ে, মস্তিষ্ক যেন ঠিকমতো “কথা বলতে” পারে না।

অনিয়মিত ওষুধের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো—মস্তিষ্কের সংকেত ধীরে ধীরে অগোছালো হয়ে যায়, যার ফলে আপনি নিজের আচরণ, অনুভূতি, এমনকি চিন্তাও ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না।

৩। হঠাৎ ওষুধ বন্ধ করলে বা ডোজ মিস করলে মস্তিষ্কে যে “ঝাঁকুনি” লাগে

অনেকেই ভাবে, “আজ একটা ওষুধ না খেলেও তো কিছু হবে না।” কিন্তু আসলে এটাই সবচেয়ে বড় ভুল। কারণ মস্তিষ্ক একটা অভ্যাস তৈরি করে ফেলে—আপনি যখন নিয়মিত ওষুধ খান, তখন মস্তিষ্ক সেই অনুযায়ী তার রাসায়নিকগুলোকে ঠিক রাখে। কিন্তু আপনি যখন হঠাৎ ডোজ মিস করেন বা ওষুধ বন্ধ করেন, তখন মস্তিষ্ক যেন হঠাৎ একটা “ঝাঁকুনি” খায়। এই ঝাঁকুনি তাকে বিভ্রান্ত করে দেয় এবং এর প্রভাব আপনার আচরণ, অনুভূতি, ঘুম, মনোযোগ—সব জায়গায় দেখা যায়।

“এক ব্যক্তি বিছানায় বসে ওষুধের বোতল হাতে, মনোযোগহীন ও হতাশ ভাব দেখাচ্ছে, মস্তিষ্কে হঠাৎ ঝাঁকুনি বা বিভ্রামের প্রতিফলন।”
মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য, ওষুধের সঠিক ব্যবহার, মেডিকেশন মিস, মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন, ওষুধ বন্ধ করার ঝুঁকি

ধরুন, আপনি প্রতিদিন সকালে ওষুধ খান। তিন দিন খাওয়ার পর চতুর্থ দিনে ভুলে গেলেন। মস্তিষ্ক আগের তিন দিনে শিখে ফেলেছে—“আমি আজ এই ওষুধ পাবো।” তাই সে তার রাসায়নিক উৎপাদন সেই হিসেবেই করেছে। কিন্তু হঠাৎ ওষুধ না পেয়ে মস্তিষ্ক গুলিয়ে যায়। ঠিক যেমন আপনি প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে প্রার্থনা করেন—একদিন হঠাৎ স্কুল গেটে গিয়ে দেখলেন স্কুল বন্ধ। আপনি কি বিভ্রান্ত হবেন না? মস্তিষ্কও ঠিক এমনভাবে বিভ্রান্ত হয়।

এই বিভ্রান্তি থেকেই হয়—

  • মাথা হালকা ঘোরা
  • মেজাজ হঠাৎ খারাপ হয়ে যাওয়া
  • অকারণে রাগ
  • ভয় লাগা বা অস্থির অনুভব
  • শরীর কাঁপা বা দুর্বলতা
  • মনোযোগ হারিয়ে ফেলা

আরও বড় সমস্যা হলো—ওষুধ যদি মানসিক স্বাস্থ্য, ঘুম, ডিপ্রেশন, উদ্বেগ বা মুড কন্ট্রোলের জন্য হয়, তাহলে হঠাৎ বন্ধ করলে “মস্তিষ্কের রাসায়নিক” হঠাৎ নিচে নেমে যায়। এতে মস্তিষ্ক নিজের ভারসাম্য রাখতে পারে না। অনেক রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায়—হঠাৎ চোখে ঝিলিক দেখা, শরীর কাঁপা, মনে হতে থাকে মাথার ভেতর “ইলেকট্রিক শক” লাগছে। এটাকেই বলা হয় Withdrawal Effect—মানে মস্তিষ্ক ওষুধ না পেয়ে প্রতিবাদ করছে।

যদি কেউ নিজের ইচ্ছায় ওষুধ বন্ধ করে দেয়, তা হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। কারণ মস্তিষ্ক একটি নির্দিষ্ট মাত্রা অনুযায়ী কাজ করে। সেই মাত্রা হঠাৎ বদলে দিলে রাসায়নিকগুলো দ্রুত ওঠানামা করতে থাকে। এতে আপনি স্বাভাবিক আচরণও ঠিক রাখতে পারবেন না।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—ওষুধ হঠাৎ বন্ধ করা শুধু মস্তিষ্কের জন্য বিপজ্জনক নয়, এটি আপনার পুরো শরীরের ভারসাম্য এলোমেলো করে দিতে পারে। তাই ডাক্তার যখন বলেন ধীরে ধীরে ওষুধ কমাতে, এর কারণ মস্তিষ্ককে সময় দিতে হয় নতুন পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে।

মস্তিষ্ক খুব সংবেদনশীল। তাকে ধীরে ধীরে পরিবর্তন বুঝতে দিতে হয়। হঠাৎ বন্ধ বা ডোজ মিস করা মানে মস্তিষ্ককে জোরে ধাক্কা দেওয়া—যা কখনোই ভালো নয়।

৪। অনিয়মিত ওষুধ কীভাবে মনোভাব, ঘুম, স্মৃতি ও আচরণকে ধীরে ধীরে বদলে দেয়

আমাদের মস্তিষ্ক শুধু ভাবনা বা সিদ্ধান্তই নেয় না—এটি আমাদের মনোভাব, ঘুম, স্মৃতি, আচরণ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। মস্তিষ্কের ভেতরের রাসায়নিকগুলো ঠিকভাবে কাজ করলে মানুষ শান্ত থাকে, ভালো ঘুম হয়, পড়াশোনা মনে থাকে, এবং আচরণও স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু যখন আমরা ওষুধ অনিয়মিতভাবে খাই, তখন মস্তিষ্কের এই নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাগুলো ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করে।

একজন ব্যক্তি বিছানায় শুয়ে আছে, তার ঘুম, মনোভাব ও আচরণের ওপর ওষুধের নিয়মিত গ্রহণের গুরুত্ব বোঝাচ্ছে।
অনিয়মিত ওষুধ গ্রহণ ধীরে ধীরে মনোভাব, ঘুম, স্মৃতি ও আচরণে প্রভাব ফেলে।

প্রথমে দেখা যায় মুড বা মনোভাবের পরিবর্তন
ধরুন, আপনার সেরোটোনিন নামের রাসায়নিকটি মন ভালো রাখতে সাহায্য করে। ডাক্তার যে ওষুধ দেন, সেটি প্রতিদিন খেতে হয় যাতে এই রাসায়নিকের মাত্রা ঠিক থাকে। আপনি যদি মাঝেমধ্যে ওষুধ বাদ দেন, সেরোটোনিন কমে যায়। এতে আপনি হঠাৎ মন খারাপ, রাগ, অস্থিরতা বা দুঃখ অনুভব করতে পারেন। মনে হবে—“কেন যেন ভালো লাগছে না।” অথচ কারণটা হলো ওষুধের অনিয়ম।

পরের ধাপে আসে ঘুমের সমস্যা
মস্তিষ্কে মেলাটোনিনসহ আরও কিছু রাসায়নিক আছে যেগুলো ঘুম আসার সংকেত দেয়। ওষুধ যদি এই রাসায়নিককে প্রভাবিত করে, তাহলে নিয়মমাফিক না খেলে ঘুম আর ঠিক সময়ে আসে না। কখনো ঘুম আসতে চায় না, আবার কখনো অল্প সময়েই ঘুম ভেঙে যায়। ফলে সকালে ঘুম ঘুম ভাব থাকে, শরীর ক্লান্ত থাকে, এবং মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

এরপর দেখা যায় স্মৃতির সমস্যা
মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্য নষ্ট হলে নতুন কিছু মনে রাখা কঠিন হয়। পড়া ভুলে যাওয়া, সহজ কাজেও বিভ্রান্ত হওয়া, কোথায় কী রেখেছেন ভুলে যাওয়া—এসবই হতে পারে। ছোট বাচ্চারও এমন সমস্যা দেখা দিতে পারে যদি সে নিয়মিত ওষুধ না খায়।

সবশেষে আসে আচরণগত পরিবর্তন
মানুষের আচরণ মস্তিষ্কের উপর পুরোপুরি নির্ভর করে। মস্তিষ্ক যদি ঠিক বার্তা না পাঠায়, তাহলে আচরণও বদলে যায়। আপনি হয়তো অকারণে রাগ করবেন, কথা কম-বেশি বলবেন, অস্থির হয়ে উঠবেন বা খুব চুপচাপ হয়ে যাবেন। পরিবারও তখন বুঝতে পারে—“কিছু একটা ঠিক নেই।”

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—এই পরিবর্তনগুলো হঠাৎ হয় না; ধীরে ধীরে ঘটে। তাই অনেকেই বুঝতে পারেন না সমস্যার মূল কারণ অনিয়মিত ওষুধ গ্রহণ

মস্তিষ্ক এমন একটি অঙ্গ, যে নিয়ম ভালোবাসে। নিয়ম ভাঙলেই সে অস্থির হয়ে যায়। আর সেই অস্থিরতার প্রভাব পড়ে আমাদের পুরো জীবনে।

৫। নিয়ম মেনে ওষুধ খেলে কীভাবে মস্তিষ্ক আবার সুস্থ ভারসাম্যে ফিরে আসে

মস্তিষ্ক এক ধরনের “সংবেদনশীল মেশিন”—এটি নিয়ম পছন্দ করে। আপনি যদি নিয়ম ভাঙেন, মস্তিষ্ক বিভ্রান্ত হয়। আর আপনি যদি নিয়ম মেনে ওষুধ খান, মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে শান্ত হয় এবং আবার ভারসাম্যে ফিরে আসে। এজন্যই ডাক্তার সবসময় বলেন—“ওষুধ নিয়ম করে খেতে হবে।” শুধু খাওয়ার সময়ই নয়, প্রতিদিন একই সময়ে খাওয়াটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।

এই চিত্রটি দেখাচ্ছে কিভাবে একজন মানুষের ঘুম, মনোভাব, স্মৃতি এবং আচরণ ওষুধ নিয়মিত না নেওয়ায় ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে পারে। মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্য ঠিক রাখতে ওষুধের নিয়মিত গ্রহণ কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা এই ছবির মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে।
অনিয়মিত ওষুধ গ্রহণ ধীরে ধীরে মনোভাব, ঘুম, স্মৃতি ও আচরণে প্রভাব ফেলে।

ধরুন আপনার মস্তিষ্কের রাসায়নিকগুলো একটি বড় অর্কেস্ট্রার মতো। প্রতিটি যন্ত্র তার নিজের ছন্দে বাজতে থাকে। ওষুধ হলো সেই কন্ডাক্টর, যে পুরো অর্কেস্ট্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। যখন ওষুধ নিয়মমতো নেওয়া হয়, এই “মিউজিক” বা ছন্দ সুন্দরভাবে চলে। মস্তিষ্ক ঠিকভাবে সংকেত পাঠায়, মন ভালো থাকে, ঘুম ঠিক হয়, স্মৃতি ভালো থাকে—সবই খুব সুন্দরভাবে কাজ করে।

যখন আপনি প্রতিদিন ঠিক সময়ে ওষুধ খান—

  • মস্তিষ্কের রাসায়নিকগুলো ধীরে ধীরে স্থির মাত্রায় থাকে
  • আর কোনো হঠাৎ ওঠানামা হয় না
  • সংকেত পাঠানোর পথগুলো গুছিয়ে যায়
  • মনোভাব স্থির হয়
  • ঘুমের চক্র ঠিক হয়
  • স্মৃতিশক্তি বাড়ে
  • আচরণ স্বাভাবিক হয়

একটা সহজ উদাহরণ:
যদি আপনার স্মার্টফোনে প্রতিদিন একই সময়ে চার্জ দেন, সেটি ভালোভাবে কাজ করবে। কিন্তু যদি একদিন পুরো চার্জ, আরেকদিন অর্ধেক, আরেকদিন কোনো চার্জ না দেন—ফোন বারবার হ্যাং করবে। আপনার মস্তিষ্কও এমন—নিয়মিত ও সঠিক সময়ের “চার্জ” মানে ওষুধ।

আরেকটা বড় উপকার হলো—মস্তিষ্ক নতুন নিয়মে মানিয়ে নিতে সময় পায়। ওষুধের প্রভাব ধীরে ধীরে জমা হয়। এতে মস্তিষ্ক তার ভেতরের রাসায়নিকদের নির্দেশ দিতে পারে—“তোমরা এভাবে কাজ করবে।” ফলে মস্তিষ্কের ভেতরের “দল” আবার একসাথে তাল মিলিয়ে কাজ শুরু করে।

ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেলে যে সুবিধাগুলো পাওয়া যায়—

  • মাথা শান্ত থাকে
  • অকারণে রাগ বা দুশ্চিন্তা কমে
  • মনোযোগ বাড়ে
  • স্কুল বা কাজের পারফরম্যান্স ভালো হয়
  • শরীরও ভালো থাকে
  • পরিবারও মনে করে—“আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেছে”

এটা অনেক বাবা-মা বা পরিবারের মানুষ প্রথমে টের পায়—বাচ্চা বা বড় কেউ নিয়ম করে ওষুধ খেলে আচরণ আগের মতো হয়ে যায়। তার হাসি, খেলা, মনোযোগ, কথা বলার ধরন—সবকিছু উন্নতি করে।

সবশেষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্য হলো—
🟢 নিয়ম মেনে ওষুধ খাওয়া মানে মস্তিষ্ককে নিজের স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার সুযোগ দেওয়া।
🟢 আর অনিয়ম মানে সেই ছন্দ নষ্ট করা।

মস্তিষ্ক যত নিয়ম পায়, তত ভালোভাবে কাজ করে।

উপসংহার 

অনিয়মিতভাবে ওষুধ খাওয়া শুধু শরীরের জন্য নয়, মস্তিষ্কের জন্যও বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। মস্তিষ্কের ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিকগুলো ঠিকভাবে কাজ করতে নিয়ম প্রয়োজন, আর সেই নিয়ম ভাঙলেই ভারসাম্য নষ্ট হয়। 

এতে মনোভাব, ঘুম, স্মৃতি ও আচরণ—সবকিছুতেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। তবে সুখের খবর হলো, নিয়ম মেনে ডাক্তারি নির্দেশ অনুযায়ী ওষুধ খেলে মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তাই নিজের এবং পরিবারের সুস্থতার জন্য ওষুধ ঠিক সময়ে, ঠিক ডোজে এবং নিয়মিতভাবে খাওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ উপায়।

Leave a Comment

You cannot copy content of this page