“জুট: সোনার ফাইবারের ইতিহাস, শিল্প ও গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ জ্ঞান ৫০ প্রশ্নে”

Spread the love

জুটকে সোনার ফাইবার হিসেবে পরিচিত। এটি প্রাকৃতিক এবং পরিবেশবান্ধব ফাইবার, যা বহু বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। জুট শুধুমাত্র একটি টেক্সটাইল ফাইবার নয়, এটি নন-টেক্সটাইল পণ্যের জন্যও কাঁচামাল সরবরাহ করে। হেসিয়ান, ব্যাগ, দড়ি, কার্পেট ব্যাকিং থেকে শুরু করে আধুনিক ডেকোরেটিভ ফ্যাব্রিক, সফট ল্যাগেজ ও ফ্যাশন সামগ্রী পর্যন্ত জুটের ব্যবহার বিস্তৃত।

বাঙালি কৃষকরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জুট চাষে পারদর্শী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, আমেরিকান গৃহযুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে জুট শিল্প বিশ্বের বাজারে বিশেষ স্থান অর্জন করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জুট শিল্প পুনর্গঠন এবং আধুনিকায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ও রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

পরিচিতি ও সাধারণ তথ্য

  1. জুট কী নামে পরিচিত?
    উত্তর: সোনার ফাইবার (Golden Fibre)।
  2. জুট কী ধরনের ফাইবার?
    উত্তর: প্রাকৃতিক ফাইবার (Natural Fibre)।
  3. জুট বিশ্বের টেক্সটাইল ফাইবার উৎপাদনে কোন ফাইবারের পরে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে?
    উত্তর: কটনের পরে।
  4. জুটের প্রধান উৎপাদনকারী দেশগুলো কোনগুলো?
    উত্তর: ভারত, বাংলাদেশ, চীন, থাইল্যান্ড।
  5. জুট কোন অন্য দেশেও উৎপাদিত হয়?
    উত্তর: দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া এবং ব্রাজিলে।
  6. জুটের আরেকটি নাম কী?
    উত্তর: পাট, কস্তা, নলিতা, বিমলী বা মেস্তা (কেনাফ)।
  7. জুটের কিছু বিশেষ গুণ কী কী?
    উত্তর: উচ্চ টেনসাইল শক্তি, কম প্রসারণযোগ্যতা, মধ্যম তাপ ও আগুন প্রতিরোধ ক্ষমতা, দীর্ঘ স্ট্যাপল লেন্থ, জীবাণু হ্রাসকারী ও পরিবেশবান্ধব।
  8. জুট কি পরিবেশ বান্ধব?
    উত্তর: হ্যাঁ, এটি বায়োডিগ্রেডেবল এবং পরিবেশবান্ধব।
  9. জুটের তুলনায় সিন্থেটিক ফাইবারের উপকারিতা ও অসুবিধা কী?
    উত্তর: জুটের তুলনায় সিন্থেটিক ফাইবার পরিবেশে ক্ষতিকর, জুটের টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব।
  10. জুটের প্রধান ব্যবহার ক্ষেত্র কোনগুলো?
    উত্তর: হেসিয়ান, স্যাকিং, কার্পেট ব্যাকিং, মাদুর, ব্যাগ, তাপরোলিন, দড়ি এবং টুইন তৈরিতে।

উন্নত ও বৈচিত্র্যময় ব্যবহার

  1. আধুনিক সময়ে জুটের ব্যবহার কী কী ক্ষেত্রে বিস্তৃত হয়েছে?
    উত্তর: ডেকোরেটিভ ফ্যাব্রিক, চিক-সারি, স্যালওয়ার কামিজ, সফট ল্যাগেজ, ফুটওয়্যার, গ্রীটিং কার্ড, ডোর প্যানেল ইত্যাদিতে।
  2. জুট কোন ফাইবারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়?
    উত্তর: দামী ফাইবার এবং বিরল বনজাতীয় উপকরণের বিকল্প।
  3. জুটের ব্যবহার পরিবেশকে কীভাবে রক্ষা করে?
    উত্তর: বন উজাড় রোধ করে, মাটির উর্বরতা বাড়ায় এবং পরিবেশবান্ধব।

জুট শিল্পের ইতিহাস

  1. বাঙালির অর্থনৈতিক উন্নয়নে কোন শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে?
    উত্তর: জুট শিল্প।
  2. ২০শ শতাব্দীর শুরুতে বঙ্গের প্রধান শিল্প কী ছিল?
    উত্তর: জুট শিল্প।
  3. ১৯০০-০১ সালে জুটের রপ্তানির অংশ মোট রপ্তানি বাণিজ্যের কত ভাগ ছিল?
    উত্তর: প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
  4. প্রথমদিকে জুট শিল্পকে কে নিয়ন্ত্রণ করত?
    উত্তর: প্রথমে ইউরোপীয়রা, পরে মারওয়ারি।
  5. জুট কারখানায় শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় কতাংশ ছিলেন অ-বাঙালি?
    উত্তর: প্রায় তিন-চতুর্থাংশ।
  6. কাঁচা জুট প্রথমে কোথা থেকে আসে?
    উত্তর: পূর্ব বঙ্গে।
  7. ১৮৫৫ সালে প্রথম জুট মিল কোথায় প্রতিষ্ঠিত হয়?
    উত্তর: হুগলির তীরে রিসর-কলকাতায়।
  8. প্রথম জুট মিল প্রতিষ্ঠার দেরি কেন হলো?
    উত্তর: প্রযুক্তি এবং শক্তি সাপ্লাইয়ের অভাবে।
  9. ১৮৫৪ সালে কোথায় কয়লাখন খোলা হয়েছিল?
    উত্তর: রাণিগঞ্জে।
  10. প্রথম মিল স্থাপন করেছিলেন কে?
    উত্তর: জর্জ অকল্যান্ড, একজন ইংরেজ।
  11. প্রথম সফল জুট মিলটি কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?
    উত্তর: বর্ণি কোম্পানি (Bornee Company)।

জুট শিল্পের বিকাশ ও বিশ্ব বাজার

  1. ডান্ডির ফ্ল্যাক্স মিল কেন জুট মিল এ রূপান্তরিত হয়?
    উত্তর: ফ্ল্যাক্স সরবরাহ কমে যাওয়ায় জুটের প্রয়োজন বৃদ্ধি পাওয়ায়।
  2. কোন যুদ্ধ জুটের চাহিদা বাড়িয়েছিল?
    উত্তর: আমেরিকান গৃহযুদ্ধ (১৮৬১-৬৫) এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
  3. জুট শিল্পের স্থায়ী পরিবর্তনের প্রধান কারণ কী ছিল?
    উত্তর: তুলনামূলক খরচ সুবিধা।
  4. জুট মিল কোন দেশে দ্রুত প্রসারিত হয়েছিল?
    উত্তর: যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, রাশিয়া, ব্রাজিল ও বঙ্গ।
  5. ১৮৭২ সালে জুট প্রধানত কোন জেলায় চাষ হত?
    উত্তর: পাবনা, বগড়া, দার্জিলিং, দিনাজপুর, রংপুর, হুগলি (পশ্চিমবঙ্গ)।
  6. ১৯১৪ সালে প্রধান জুট চাষের জেলা কোনগুলো ছিল?
    উত্তর: রংপুর, বগড়া, তিপ্পেরা (কুমিল্লা), পাবনা, ঢাকা, ফরিদপুর, হুগলি, রাজশাহী, যশোর, নাডিয়া, দিনাজপুর।

জুটের অর্থনৈতিক প্রভাব

  1. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জুটের চাহিদা কেন বেড়েছিল?
    উত্তর: সৈনিকদের জন্য স্যান্ডব্যাগ এবং খাবারের জন্য গন্নি ব্যাগ তৈরিতে।
  2. ১৯২৯-৩৩ অর্থনৈতিক মন্দার সময় জুট শিল্পের অবস্থা কেমন ছিল?
    উত্তর: জুটের চাহিদা কমে যাওয়ায় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  3. ১৯৪৭ সালের বঙ্গবিভাজনের পরে জুট শিল্পের অবস্থা কেমন হয়?
    উত্তর: পূর্ব বঙ্গে মিল না থাকায় কাঁচা জুট বিপণনের সমস্যা হয়।
  4. স্বাধীন বাংলাদেশের পরে জুট শিল্পের অধিকাংশ মালিক কে চলে যায়?
    উত্তর: পাকিস্তানি মিল মালিকরা (প্রায় ৬৮%)।
  5. বাংলাদেশে জাতীয়করণের মাধ্যমে কত শতাংশ শিল্প নেওয়া হয়েছিল?
    উত্তর: প্রায় ৮৫% শিল্প।
  6. বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (BJMC) কখন গঠিত হয়?
    উত্তর: ১৯৭১ সালে।
  7. BJMC তত্কালীন কতটি মিল পরিচালনা করত?
    উত্তর: ৭৩টি মিল।
  8. BJMC কতজন শ্রমিক নিয়োগ করত ১৯৮১ সালে?
    উত্তর: প্রায় ১,৬৫,০০০ শ্রমিক এবং ২৭,০০০ প্রশাসনিক ও অফিস কর্মী।
  9. ১৯৭৯-৮০ সালে জুট শিল্পের লাভের কারণ কী ছিল?
    উত্তর: নগদ সহায়তা (Subsidy) এবং মুদ্রার মুল্য হ্রাস।
  10. BJMC কতটি মিল ১৯৮২-৮৩ সালে সঠিকভাবে পরিচালিত করত?
    উত্তর: ৪৬টি মিল।

জুটের সামাজিক ও কৃষি গুরুত্ব

  1. বাংলাদেশে প্রায় কতজন কৃষক জুট চাষের সাথে যুক্ত?
    উত্তর: প্রায় ১৫ মিলিয়ন কৃষক।
  2. জুট শিল্পে কতজন লোক যুক্ত?
    উত্তর: কৃষি, বিপণন, উৎপাদন, পরিবহন ও প্রক্রিয়াজাতকরণসহ কয়েক মিলিয়ন লোক।
  3. জুট কী ধরনের ফসল হিসেবে পরিচিত?
    উত্তর: নগদ ফসল (Cash Crop)।
  4. জুটের পাতা কী কাজে ব্যবহৃত হয়?
    উত্তর: মাটির উর্বরতা বাড়ানো এবং সবজি হিসেবে খাদ্য যোগানো।
  5. জুটের লাঠি কোন কাজে ব্যবহার হয়?
    উত্তর: জ্বালানি এবং বেড়া নির্মাণের জন্য কাঠের বিকল্প।
  6. জুটের পরিবেশগত গুরুত্ব কী?
    উত্তর: বন উজাড় কমানো, মাটির গঠন বজায় রাখা এবং বায়োডিগ্রেডেবল হওয়া।
  7. জুটকে কি মনসুন মৌসুমে চাষ করা যায়?
    উত্তর: হ্যাঁ।
  8. জুট চাষে ধানের সঙ্গে কীভাবে ফসল চক্র করা যায়?
    উত্তর: ধানের পরে জুট চাষ করা যায় মাটির উর্বরতা পুনরুদ্ধারের জন্য।
  9. জুট শিল্পের অর্থনৈতিক প্রভাব বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
    উত্তর: এটি সবচেয়ে বড় শিল্প, বৃহত্তম কৃষি রপ্তানি, প্রায় ২৫ মিলিয়ন মানুষের জীবিকা নির্ভর।
  10. জুটের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কেমন?
    উত্তর: পরিবেশ বান্ধব হওয়ায় এবং বৈচিত্র্যময় ব্যবহারের কারণে উজ্জ্বল।

উপসংহার

জুট বাংলাদেশের অর্থনীতি, কৃষি ও জনজীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রায় ১৫ মিলিয়ন কৃষক এবং কয়েক মিলিয়ন লোক জুট চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন ও পরিবহনে জড়িত। এটি পরিবেশবান্ধব, বায়োডিগ্রেডেবল এবং বন উজাড় কমাতে সহায়ক।

জুট শুধুমাত্র একটি কৃষিজ ফসল নয়, এটি দেশের রপ্তানি ও টেক্সটাইল শিল্পের শক্তি। বৈচিত্র্যময় ব্যবহার ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে জুটের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। সুতরাং, শিক্ষার্থীদের জন্য জুট সম্পর্কিত সাধারণ জ্ঞান জানা গুরুত্বপূর্ণ, যা তাদের ইতিহাস, অর্থনীতি এবং পরিবেশ সচেতনতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।

Leave a Comment

You cannot copy content of this page