বই পড়া কিভাবে আমাদের নৈতিক মূল্যবোধকে দৃঢ় করে

Spread the love

মানুষ হিসেবে আমরা সবাই চাই ভালো হতে, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং সমাজে সম্মানজনকভাবে বাঁচতে। এই ভালো হওয়ার মূল চাবিকাঠি হলো আমাদের নৈতিক মূল্যবোধ। কিন্তু প্রশ্ন হলো—নৈতিক মূল্যবোধ আমরা কিভাবে গড়ে তুলব? অনেকেই বলে, পরিবার থেকে শেখা যায়, স্কুল থেকে শেখা যায়, কিংবা অভিজ্ঞতা থেকে শেখা যায়। কিন্তু একটি চমৎকার ও সহজ উপায় আছে যা আমাদের ভেতর থেকে পরিবর্তন আনে—বই পড়া।

বই শুধু জ্ঞান বাড়ায় না, আমাদের মনের ভেতরের ভালো মানুষটাকেও জাগিয়ে তোলে। যখন আমরা গল্পের চরিত্রের সুখ-দুঃখ অনুভব করি, ইতিহাসের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিই, কিংবা কোনো প্রবন্ধে জীবনের সত্যি উপলব্ধি করি, তখন অজান্তেই আমাদের মনে ভালো-মন্দের পার্থক্য স্পষ্ট হয়। এক অর্থে বই আমাদের মনের আয়না; যেখানে আমরা নিজেদের মূল্যবোধকে নতুন করে চিনতে শিখি।

আজকের এই আলোচনায় আমরা জানব—বই পড়া কিভাবে আমাদের নৈতিক মূল্যবোধকে দৃঢ় করে। আমি এটি ৫টি ধাপে বুঝিয়ে বলব, যেখানে থাকবে বাস্তব অভিজ্ঞতা, সহজ উদাহরণ ও এমন ব্যাখ্যা যা ৭ বছরের বাচ্চাও সহজে বুঝতে পারবে।

১। বই আমাদের চিন্তাভাবনা প্রসারিত করে

নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠার প্রথম ধাপ হলো চিন্তাভাবনা বা মনোভাবের পরিবর্তন। আমরা যখন ছোট হই, তখন আমাদের চিন্তা সীমাবদ্ধ থাকে নিজের পরিবার, স্কুল বা আশপাশের কয়েকজন মানুষের মধ্যেই। কিন্তু বই আমাদের সেই ছোট দিগন্ত ভেঙে দেয়। একেকটি বই যেন একেকটি নতুন জানালা, যা খুলে দিলে আমরা ভিন্ন ভিন্ন মানুষের জীবন, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা দেখতে পাই।

ধরুন, আপনি একটি গল্প পড়ছেন যেখানে একটি ছোট ছেলে তার খাবার গরিব বন্ধুর সাথে ভাগ করে নিচ্ছে। এই গল্পটি পড়ে আপনার মনেও প্রশ্ন জাগবে—“আমিও কি এমনটা করি? আমারও কি উচিত নয় নিজের জিনিস ভাগাভাগি করা?” এভাবেই বই আমাদের শেখায় কিভাবে অন্যের অনুভূতি বোঝা যায় এবং কিভাবে দয়া বা সহমর্মিতা তৈরি হয়।

শুধু গল্প নয়, জীবনীমূলক বইও আমাদের চিন্তাভাবনা বদলে দেয়। যেমন, মহাত্মা গান্ধী, কাজী নজরুল ইসলাম বা শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী পড়লে আমরা বুঝতে পারি তারা কেমন নৈতিকতার সাথে জীবনযাপন করতেন। তাদের নীতিবোধ ও সাহসিকতা আমাদের মনে অনুপ্রেরণা জাগায় সৎ পথে চলার।

আরেকটি বিষয় হলো, বই আমাদের শেখায় প্রশ্ন করতে। “কেন আমি এমন ভাবছি?”, “কেন এটা ভালো বা মন্দ?”, এই প্রশ্নগুলো যখন আমাদের মনে জন্মায়, তখনই আমরা নৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত হই। সঠিক-ভুলের পার্থক্য বুঝতে শেখাই হলো মূল্যবোধ গঠনের প্রথম ধাপ, আর বই এই কাজটাই করে দেয় সবচেয়ে সহজভাবে।

২। বই আমাদের সহমর্মিতা ও দয়া শেখায়

নৈতিক মূল্যবোধের অন্যতম বড় অংশ হলো সহমর্মিতা, অর্থাৎ অন্যের অনুভূতি বুঝতে পারা ও সেই অনুযায়ী আচরণ করা। বই পড়া এই গুণটি গড়ে তুলতে অবিশ্বাস্যভাবে সাহায্য করে। কারণ, যখন আমরা কোনো চরিত্রের গল্প পড়ি, তখন আমরা তার চোখ দিয়ে পৃথিবীকে দেখতে শিখি।

ধরুন, আপনি একটি গল্প পড়লেন যেখানে এক গরিব ছেলে তার মায়ের চিকিৎসার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে। গল্প পড়তে পড়তে আমরা তার কষ্ট অনুভব করি, তার স্বপ্ন দেখি এবং তার খুশিতে খুশি হই। এর ফলে আমাদের ভেতরেও দয়ার অনুভূতি জন্মায়। পরবর্তীতে আমরা বাস্তব জীবনে এমন কাউকে দেখলে সাহায্য করতে আগ্রহী হই।

এছাড়াও শিশুদের জন্য লেখা নীতিগল্প বা রূপকথার গল্পগুলোও সহমর্মিতা গড়ে তুলতে কার্যকর। যেমন, “সিংহ আর ইঁদুরের গল্প”—যেখানে বড় প্রাণী ছোট প্রাণীর সাহায্যে কৃতজ্ঞ হয়। এই ধরনের গল্প আমাদের শেখায়, প্রত্যেকের মূল্য আছে, বড়-ছোট কাউকে অবহেলা করা উচিত নয়।

সহমর্মিতা তৈরি হলে মানুষ কেবল নিজের স্বার্থ নয়, অন্যের সুখ-দুঃখও বিবেচনা করতে শেখে। সমাজে শান্তি, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা গড়ে তুলতে এটাই সবচেয়ে জরুরি নৈতিক শিক্ষা। বই পড়ার মাধ্যমে এই গুণটি ছোট থেকে বড় সবার মধ্যেই স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠে।

৩। বই আমাদের সঠিক-ভুলের বোধ তৈরি করে

নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সঠিক আর ভুলের পার্থক্য বোঝা। আমরা যখন বই পড়ি, বিশেষ করে গল্প, জীবনী বা ইতিহাসের বই, তখন সেখানে ভালো-মন্দ চরিত্র ও তাদের কাজ স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এসব পড়ে আমরা সহজেই বুঝতে পারি কোন কাজটি প্রশংসনীয় আর কোনটি নিন্দনীয়।

উদাহরণ হিসেবে ভাবুন—গল্পে যদি একজন চরিত্র মিথ্যা বলে সমস্যায় পড়ে আর অন্য একজন সত্য কথা বলে সবার শ্রদ্ধা পায়, তখন পাঠকের মনে স্বাভাবিকভাবেই সত্যবাদিতার প্রতি সম্মান জন্মায়। এই অভ্যাস ছোট থেকে গড়ে উঠলে বড় হয়ে আমরা সহজে মিথ্যা বলা বা অন্যায় কাজ করতে পারি না।

ইতিহাসের বইও এখানে বড় ভূমিকা রাখে। যেমন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়লে আমরা বুঝতে পারি স্বাধীনতার জন্য কেমন ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল। যারা দেশকে ভালোবেসে জীবন দিয়েছে, তারা আমাদের শেখায় দেশপ্রেম, সততা ও দায়িত্ববোধ কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

এছাড়া নীতিকথা বা প্রবন্ধ পড়ে আমরা জীবনের গভীর শিক্ষা পাই। অনেক বই সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করে কেন দয়া, সততা, সহযোগিতা বা সম্মান দেখানো গুরুত্বপূর্ণ। এসব শিক্ষা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে—যেমন বন্ধুর সাথে আচরণ, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব কিংবা সমাজের প্রতি কর্তব্য।

এভাবেই বই আমাদের নৈতিক কম্পাসের মতো কাজ করে, যা সব পরিস্থিতিতে সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়।

৪। বই আমাদের ধৈর্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখায়

নৈতিক মূল্যবোধের একটি বড় অংশ হলো ধৈর্যআত্মনিয়ন্ত্রণ। জীবনের নানা সময় আমরা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হই যেখানে রাগ, বিরক্তি বা অধৈর্যতা আমাদের ভুল পথে ঠেলে দেয়। কিন্তু বই পড়ার অভ্যাস আমাদের ভেতরে ধৈর্যশীলতা তৈরি করে।

প্রথমত, বই পড়তে গিয়েই আমরা ধৈর্য শিখি। একটি বই শুরু করে শেষ করা সময়সাপেক্ষ কাজ। ধীরে ধীরে পড়তে পড়তে আমাদের মনও শান্ত হয়। যেমন, বড় কোনো উপন্যাস পড়তে গেলে পাঠকের ধৈর্য ধরে রাখতে হয়; এর ফলে জীবনের অন্যান্য কাজেও ধৈর্য প্রয়োগ করা সহজ হয়।

দ্বিতীয়ত, অনেক বই সরাসরি আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দেয়। যেমন, এমন গল্প যেখানে একজন চরিত্র রাগ দমন করে বড় বিপদ এড়িয়ে যায় বা ধৈর্য ধরে শেষ পর্যন্ত সফল হয়। এসব গল্প আমাদের বাস্তব জীবনে একই কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে।

শিশুদের গল্পেও এর উদাহরণ দেখা যায়। যেমন, “কচ্ছপ আর খরগোশের গল্প”—যেখানে ধীর কিন্তু ধৈর্যশীল কচ্ছপ শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। এই গল্প শিশুদের শেখায় যে তাড়াহুড়ো না করে ধৈর্য ধরে কাজ করলে সাফল্য নিশ্চিত হয়।

বইয়ের চরিত্র থেকে শেখা এই ধৈর্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণ আমাদের বাস্তব জীবনে নৈতিকভাবে শক্তিশালী করে। যখন কেউ রাগিয়ে দেয়, আমরা সহজে সহ্য করতে পারি; যখন প্রলোভন আসে, আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি।

৫। বই আমাদের আত্মবিশ্বাস ও নৈতিক সিদ্ধান্তে দৃঢ়তা দেয়

নৈতিক মূল্যবোধ থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় মানুষ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পায় বা দ্বিধায় ভোগে। বই পড়া এই সমস্যা দূর করে, কারণ বই আমাদের জ্ঞানের পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসও বাড়ায়।

যখন আমরা নানারকম চরিত্রের অভিজ্ঞতা পড়ি, তখন বুঝতে পারি—জীবনে চ্যালেঞ্জ আসবে, কিন্তু সঠিক পথে থাকলে জয় অবশ্যম্ভাবী। উদাহরণ হিসেবে, মুক্তিযোদ্ধাদের কাহিনি বা কোনো সৎ নেতার জীবনী পড়লে আমরা শিখি কিভাবে তারা নীতির পথে থেকেও সফল হয়েছেন। এই গল্পগুলো আমাদের মনে সাহস জাগায়, যেন আমরাও একইভাবে সৎ পথে থাকতে পারি।

বই আরও শেখায় নৈতিক সিদ্ধান্তে দৃঢ় থাকতে। ধরুন, একটি গল্পে একজন চরিত্র বন্ধুর ভুল কাজের বিরোধিতা করে। শুরুতে সে একা হয়ে গেলেও শেষে সবার শ্রদ্ধা পায়। এই ধরনের ঘটনা আমাদের মনে গভীর ছাপ ফেলে এবং বাস্তব জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ভয় দূর করে।

এছাড়া বই পড়লে ভাষা ও জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়, ফলে আমরা আত্মবিশ্বাসের সাথে মতামত প্রকাশ করতে পারি। যখন কেউ আমাদের ভুল পথে প্রলুব্ধ করে, তখন আমরা তথ্য ও নীতির ভিত্তিতে দৃঢ়ভাবে “না” বলতে পারি।

সবশেষে, বই আমাদের মনে করিয়ে দেয়—নৈতিকভাবে শক্তিশালী মানুষ শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজের জন্যও আশীর্বাদ। একজন সৎ মানুষ সমাজকে বদলে দিতে পারে, আর সেই শক্তির বড় উৎসই হলো জ্ঞান ও বইপড়া।

উপসংহার

বই পড়া শুধু মজার কাজ নয়, এটি আমাদের জীবনের জন্য অনেক বড় উপহার। বইয়ের মাধ্যমে আমরা চিন্তাভাবনা প্রসারিত করি, সহমর্মিতা ও দয়া শেখি, সঠিক আর ভুলের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি, ধৈর্য ধারণ করি এবং আত্মবিশ্বাস অর্জন করি। এসব গুণ আমাদের নৈতিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করে। তাই ছোট থেকে বড় সবাইকে নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। কারণ বই আমাদের মনের দরজা খুলে দেয়, আর নৈতিক মূল্যবোধ আমাদের জীবনের সঠিক পথ দেখায়। সুতরাং, বই পড়ার মাধ্যমে আমরা শুধু নিজেদের নয়, সমাজকেও সুন্দর ও উন্নত করতে পারি।

Leave a Comment

You cannot copy content of this page