ব্যর্থতা মানুষের জীবনের একটি সাধারণ অধ্যায়। সচরাচর এটি আমাদের মধ্যে নেতিবাচক সংকেত হিসাবে পরিচিত। তবে এই ব্যর্থতা আমাদের জীবনে নতুন পথের সূচনা করতে সহায়ক হতে পারে এবং দৃঢ়ভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগাতে পারে। তাই জীবনে বার বার ব্যর্থতা হলে ভেঙে না পরে নতুন উদ্যম নিয়ে আবার শুরু করলে আমরা সহজেই আমাদের লক্ষ্যে পৌছাতে পারি। কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরন করে আমরা আমাদের ব্যর্থতাকে জয় করে জীবনকে সুন্দর করতে পারি।
নিচের আলোচনায় আমরা দেখবো জীবনে বার বার ব্যর্থ হলে কিভাবে আমরা তা কাটিয়ে উঠতে পারি।
ব্যর্থতায় করনীয় কী?
জীবনে ব্যর্থতা আসবেই তবে হতাশ হওয়া যাবে না। ব্যর্থতার পর কিছু করনীয় আছে যা জীবনে সাফল্য বয়ে আনে। চলুন দেখা যাক ব্যর্থতায় কী কী করনীয়গুলো আমরা অনুসরন করতে পারি।
- নিজেকে গুরুত্ব দেয়া
জীবনের যেকোন ক্ষেত্রেই কেউ যদি সফল হতে চায় তাকে অবশ্যই নিজের যত্ন নিতে শিখতে হবে। যদি নিজেকে সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দেয়া না যায়, তাহলে জীবনের ভারসাম্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে। সফল হতে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী জরুরী। তাই নিজের পরিবার ও ঘনিষ্ঠ মানুষদের দৈনন্দিন খোজখবর রাখতে হবে। যদিও হয়ত রোজ এ কাজটি করা কঠিন, তবু চেষ্টা করতে হবে।
- নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করা
অতীতে ব্যর্থ হয়ে থাকলে ভবিষ্যতের জন্য কিছু বাস্তববাদী লক্ষ্য স্থির করতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ চালিয়ে যেতে হবে। কোন কাজগুলো বাছাইকরণের মাধ্যমে সফলতা লাভ করা যায় তা খুঁজে বের করতে হবে। বার বার ব্যর্থতা আসলে ভেঙে না পড়ে প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে হবে। সাপ্তাহিক, মাসিক, বাৎসরিক কাজগুলোকে ভাগ করে কাজ করতে হবে। নিজের জীবনে কী কী অর্জন করতে চান, পরবর্তী ছয় মাসে কী কী অর্জন করতে চান, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে নিজেকে কোথায় দেখতে চান সেগুলো স্থির করতে হবে এবং প্রত্যাশা অনুযায়ী পরিশ্রম করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পরিশ্রম সৌভাগ্যের চাবিকাঠি।
- ধারাবাহিকতা রক্ষা করা
কোন কাজে ব্যর্থ হলে হাল ছাড়া যাবে না। ধৈর্য্য নিয়ে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যেতে হবে, তবেই সফলতা আসবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির অসউইজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে ফিরে আসা মনোবিজ্ঞানী এডিথ এজের নিজেকে সবসময় পর্বতারোহী মনে করতেন। তিনি বলেন “একজন পর্বতারোহী যখন ওপরে উঠতে থাকেন, তিনি পিছলে পড়েন, দুই তিন ধাপ নিচে নেমে যান। কিন্তু ওপরে ওঠা থামান না তিনি। আমি সেরকম, পিছলে পড়ি কিন্তু ওপরে ওঠা থামাই না আমি, কোনদিন থামাবও না।”
- হতাশা না হওয়া
অনেকেই মনে করে তার মেধা নেই, ভালো পরিবার নেই, ভালো পরিবেশ নেই, ভালো স্কুলে পড়তে পারে নি, ভালো শিক্ষক পায়নি ইত্যাদি। এসব অজুহাত দিয়ে কোনো কাজ শুরুই করে না। কিছু করতে না পারলে অজুহাত দেখায়, অলসতা করে। ব্যর্থতার জন্য নিজেকে ছাড়া পরিবার, সমাজ, দেশ, দেশের সরকার, এমনকি ভাগ্যকেও দায়ী করে। এই অভিযোগ গুলো অনেক সময় যৌক্তিক হলেও এই সব অভিযোগ করে কোনো লাভ নেই। এতে জীবনে কোনো উন্নতি আসবে না। তাই হতাশ হওয়া যাবে না। হতাশা বন্ধ করে কাজ শুরু করলে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করে।
- অন্যরা কী ভাবছে তা না ভাবা
কেউ কাজে ব্যর্থ হওয়ার পর পুনরায় কাজ চালিয়ে যেতে হবে। অন্যরা কি ভাববে সেটা দেখার বিষয় না। কারন অন্যের ভাবনায় কারও জীবনে সফলতা আসবেনা। নিজের সম্পর্কে যে ধারণা তা অন্যের অনুমোদনের ছাড়াই সে বিশ্বাস করতে পারে। কারও পরিশ্রম অন্যের ভাবার দ্বারা ব্যর্থ হয় না।
- নিজের উপর বিশ্বাস থাকা
নিজের উপর বিশ্বাস থাকা অত্যন্ত জরুরী। নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আমরা নিজের জীবন সম্পর্কে কেমন মনোভাব পোষণ করবো। প্রত্যকেরই ইতিবাচক মনোভাবের অভ্যাস করা দরকার। ডুবে যাওয়া বা বীজ বোনা, দুটোই কিন্তু মাটি বা পানির নিচে হচ্ছে। কিন্তু অর্থ সম্পূর্ন ভিন্ন হয়। একটায় অত্যন্ত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়। অন্যটায় ইতিবাচক একটা মনোভাব বোঝা যায়, যা মানুষের চিন্তা প্রক্রিয়ায় ছাপ ফেলে।
- ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেয়াঃ
কাজ শুরু করে ব্যর্থ হওয়ার পর অনেকেই আর চেষ্টাই করে না। চেষ্টা না করা কখনই সফলতা বয়ে আনে না। বহু দিন পর চেষ্টা করার পর যখন সাফল্য এসে ধরা দেয় না তখন আমরা চেষ্টা করাই বন্ধ করে দেই। কিন্তু ব্যর্থতা জীবনের শেষ কথা নয়। ব্যর্থতাকে শেখার সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। জীবনে যত বেশি ব্যর্থ হওয়া যাবে তত বেশি সাফল্যের কাছাকাছি পৌছানো যায়। চেষ্টা করার পর ব্যর্থ হলে এটাকে ব্যর্থতা বলে না, আসল ব্যর্থতা হলো চেষ্টা না করা।
- পন্থা পরিবর্তন করা
জীবনে একবার ব্যর্থ হলে পরবর্তীতে একই পথে না হেঁটে অন্য পন্থা অবলম্বন করা উচিৎ। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে চিন্তায় এবং কাজে নতুনত্ব নিয়ে আসতে হবে। একই ভুল বার বার করা যাবে না। নিজের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য সঠিক আছে কিনা, যে সকল সমস্যা উদ্ভূত হবে তা সমাধান করতে পারব কিনা, ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত কিনা এসব বিষয়ে মাথায় রাখা উচিৎ। জীবনে সফল হতে হলে ঝুঁকি অবশ্যই নিতে হবে।
- সফল মানুষের চারপাশে থাকা
আমাদের গড়পরতা মানুষের সাথে মেলামেশা না করে এমন লোকদের সাথে মিশতে হবে যারা নিজের থেকে উন্নত মনমানসিকতা নিয়ে চলে এবং যারা ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছেন। একজন সফল ব্যক্তির সাথে একটি ভাল ইন্টার্নশিপে তিন মাস একটি এন্ট্রি-লেভেল চাকরিতে তিন বছরের অভিজ্ঞতার সমান হতে পারে। তাই তাদের সাথে কাজ করার সুযোগ না পেলেও তাদের বই পড়া, তাদের ভিডিও দেখা, তাদের ফেসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলের সাথে সংযুক্ত থাকা যেতে পারে।তাদের কোর্স করে অথবা তাদের পরামর্শের জন্য ইমেল করে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করা যেতে পারে।
- মানসিক বৈপরীত্য অনুশীলন করা
কল্পনা করতে হবে বাস্তবতার সাথে মিল রেখে। প্রথমত নিজের প্রত্যাশিত কাজটি খুঁজে বের করতে হবে যা স্বাচ্ছ্যন্দের সাথে করা যায়। সফলতার ভবিষ্যত পরিকল্পনা করার সাথে সাথে এই সফলতার পথে কোন কোন পরাজয় বা ব্যর্থতা আসতে পারে তা আগে থেকে চিন্তা করে রাখতে হবে। সকল দিক বিবেচনা করে যদি বোঝা যায় নিজের লক্ষ্য বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় তাহলে অকল্পনীয় লক্ষ্য থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবিক এবং অর্জনযোগ্য লক্ষ্যের দিকে ফোকাস করতে হবে।
- নতুন করে চেষ্টা করা
জীবনে সফল হতে হলে প্রয়োজন অদম্য চেষ্টার। নিজের নতুন গোল, নতুন পরিকল্পনা নিয়ে অবিরাম চেষ্টা করে যেতে হবে। কোন কিছু শুরু করে তার কিছুদিনের মধ্যেই চূড়ান্ত সফলতার কথা চিন্তা করা যাবে না। যে কোন সফলতার জন্য নির্দিষ্ট সময় প্রয়োজন। কৃষক একটি নির্দিষ্ট সময়ে জমিতে বীজ বপন করে এবং নির্দিষ্ট সময়ে ফসল ঘরে তোলেন, একটি শিশু জন্মের সাথে সাথেই হাঁটতে পারে না। হাঁটার জন্য উপযুক্ত বয়সের প্রয়োজন। তাই চূড়ান্ত সফল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে এবং অবিরাম পরিশ্রম করে যেতে হবে। সফলতার পথে পথে পরাজয় বিছানা পেতে থাকবে তা অস্বাভাবিক নয়। ব্যর্থতাকে জয় করে সামনে অগ্রসর হলেই প্রকৃত অর্থে সফল হওয়া যায়। জীবনে ব্যর্থতা থাকবেই। তবুও নতুন করে শুরু করতে হবে এবং সফল হওয়ার জন্য বার বার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তাইতো কবি কালীপ্রসন্ন ঘোষ বলেছেন “একবার না পারিলে দেখ শতবার।”
শেষকথা
পরিশেষে বলা যায় ব্যর্থতা আমাদেরকে প্রেরণা যোগানের মাধ্যমে নতুন উদ্যমের আলোকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করতে পারে। ব্যর্থতাকে আমাদের শিক্ষা হিসাবে গ্রহণ করা উচিত এবং বার বার ব্যর্থ হওয়ার কারন খুঁজে বের করে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে হবে, তবেই সফলতা আসবে। মনে রাখতে হবে জীবন কোনো প্রতিযোগিতা নয়। তাই বন্ধুত্বপুর্ন পরিবেশে জীবনটা উপভোগ করার মাঝেই রয়েছে আসল সফলতা।