“ক্যারিয়ার”। খুবই ছোট্ট একটি শব্দ। কিন্তু এর ব্যাপকতা বিস্তর। শুধুমাত্র এই একটি শব্দ পুরো একটি জেনারেশনকে নাড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। বর্তমানে ছেলে হোক বা মেয়ে, ছোট থেকেই তারা এই একটি শব্দ শুনেই বড় হয়, “তোমাকে নিজের ক্যারিয়ার বিল্ড করতে হবে।”
অনেকের কাছে আবার ক্যারিয়ারের ডেফিনেশনও ভিন্ন ভিন্ন। কারো মতে, ক্যারিয়ারে সফল হতে হলে ভালো কোনো নামি দামি স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করতে হবে। আবার কারো মতে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া ডিগ্রি ক্যারিয়ারে কোনো কাজে লাগেনা, যদি না তার প্র্যাক্টিক্যাল নলেজ থাকে। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে যারা ভালো স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেনা,তারা কি তাদের ক্যারিয়ার বিল্ড করবেনা?
আবার যারা ভালো ইন্সটিটিউশনে পড়াশোনা করে তারা কি এর কোনো বেনিফিট পাবেনা? ক্যারিয়ারে সফল হতে হলে কোন কোন দক্ষতা অবশ্যই প্রয়োজন? আজ আমরা এই সমস্ত প্রশ্নেরই উত্তর খোজার চেষ্টা করবো এই আর্টিক্যালের মাধ্যমে।
ক্যারিয়ার সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা
ক্যারিয়ার শব্দটির সাথে আমরা খুব বেশি পরিচিত হলেও এই সম্পর্কে ধারণা আমাদের অনেকের কাছে পুরোপুরি ক্লিয়ার নয়। “Career” শব্দটির উৎপত্তি মূলত ল্যাটিন শব্দ “Carrus” থেকে হয়েছে। “Carrus” মূলত “Chariot” যা মূলত ঘোড়ায় টানা দুই চাকা বিশিষ্ট ছাদখোলা দ্রুতগামী গাড়িকে বুঝায়। শাব্দিক সম্প্রসারনের ফলে ১৮০৩ সাল থেকে এটি কোনো ব্যাক্তির পেশাগত জীবনধারাকে বুঝায়।
সহজভাবে বলতে গেলে ক্যারিয়ার হলো একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র বা পেশায় কাজের ধারাবাহিকতা। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি তার সম্পূর্ণ জীবনে জীবিকা নির্বাহের জন্য শিক্ষা থেকে শুরু করে যে সকল কাজ করে থাকে তার সবই ক্যারিয়ারের অন্তর্ভুক্ত।
এখন চলুন আমাদের আর্টিক্যালটির শুরুতে করা সেই প্রশ্নটির উত্তর দেয়া যাক। ক্যারিয়ার জীবনে আসলে একাডেমিক শিক্ষার গুরুত্ব কতটুকু? যারা ভালো কোনো একাডেমিতে পড়াশোনা করতে পারেনা তারা কিভাবে নিজেদের ক্যারিয়ার ডেভেলপ করতে পারে? নামিদামি স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা ক্যারিয়ার জীবনে ঠিক কতটুকু এগিয়ে থাকে? উত্তর হল, অবশ্যই একাডেমিক শিক্ষার গুরুত্ব রয়েছে এবং নামি-দামি স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ও সেখান থেকে প্রাপ্ত সিজিপিএ অবশ্যই জীবনে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে তার আগে কিছু প্র্যাক্টিক্যাল স্কিল থাকা খুবই জরুরি। এই স্কিলগুলো না থাকলে শুধুমাত্র একাডেমিক শিক্ষা নিয়ে ক্যারিয়ার জীবনে নিজেকে ডেভেলপ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। আবার যাদের মাঝে এই স্কিলগুলো থাকে তারা একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড খুব বেশি ভালো না হলেও একটা নির্দিষ্ট সময় সারভাইভ করার পর সেই গ্যাপটা ফিল-আপ করতে পারে। তাই চলুন সেই নন-একাডেমিক স্কিলগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
কর্মজীবনে সাফল্যের জন্য ৫টি প্রয়োজনীয় দক্ষতা
1. কমিউনিকেশন স্কিল ডেভেলপ করুন
ছোট থেকে আমরা দেখে এসেছি যে, ক্লাসে যে শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি টিচারের সাথে কমিউনিকেশন করে বা উনার কথার রেসপন্স করে, তার প্রতি প্রায় প্রতিটি টিচারের আলাদা একটি গুরুত্ব থাকে। একই বিষয় আমাদের ক্যারিয়ারেও দেখা দেয়। কর্মক্ষেত্রে আপনি যত ভালোভাবে কমিউনিকেশন করতে পারবেন, ততই দেখবেন আপনার সহকর্মী, ক্লাইন্ট অথবা সিনিয়ররা আপনার প্রতি আলাদা একটি গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই আপনার সহকর্মীদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরন করুন। তাদের ভালো-মন্দ অথবা প্রয়োজনের খবর রাখুন। সিনিয়রদের সম্মান করুন এবং সিনিয়র/ক্লাইন্টদের দেয়া কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করে যথাসময়ে জমা দিন। কোনো কারনে কাজটি করতে অপারগ হলে সেটিও তাদের জানিয়ে রাখুন। এবং এই একটি দক্ষতা অনুসরন করার মাধ্যমে আপনি হয়ে উঠতে পারেন আপনার কর্মক্ষেত্রের সেরা একজন কর্মী।
2. স্কিল ডেভেলপ করুন
শিক্ষার কোনো শেষ নেই। আপনি যত বিষয়েই দক্ষ হোন না কেন, পৃথিবীতে এমন অনেক বিষয় থেকে যাবে যা আপনি জানেন না। তাই সবসময় নতুন কিছু জানার এবং শেখার আগ্রহ থাকতে হবে। হতে পারে, আপনি অনেক ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন এবং আপনার সিজিপিএ অনেক ভালো। কিন্তু বর্তমানে এই কম্পিটিশনের যুগে টিকে থাকতে হলে স্কিল ডেভেলপ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তাই কর্মক্ষেত্রে যে বিষয়টিই আপনার কাছে নতুন মনে হবে, সেই সম্পর্কে স্টাডি করুন। নতুন কিছু শিখার কোনো সুযোগ আসলে তা কখনোই হাতছাড়া করবেন না। প্রতিনিয়ত আপনার স্কিলগুলোকে ডেভেলপ করার মাধ্যমে আপনি আপনার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারেন।
3. মার্জিত আচরন করুন
আপনার আচরনই আপনার পরিচয় প্রকাশ করে। একজন অপরিচিত মানুষ যখন আপনার সাথে প্রথম পরিচিত হয়, তখন তিনি অবশ্যই আপনার আচরন লক্ষ্য করে থাকে। তাই সবসময় মার্জিত আচরন করা অপরিহার্য। আপনি যদি আপনার কর্মক্ষেত্রে ভালো কোনো পজিশনে থাকেন এবং সেখান থেকে আপনার সহকর্মী বা এমপ্লয়িদের সাথে খারাপ আচরণ করেন, তাহলে আপনি ভুল করছেন। কারন সময় এবং পরিস্থিতি দুটোই পরিবর্তনশীল। হতে পারে, একটা সময়ে আপনার আচরনের জন্য আপনাকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তাই সবসময় মার্জিত আচরন করাই বাঞ্চনীয়।
4. টাইম মেনেজমেন্ট
আমাদের স্বাভাবিক জীবনে যেমন সময়ের গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি কর্মজীবনেও সময়ের গুরুত্ব অপরিসীম। আপনি কোনো কাজ যদি নিজের ইচ্ছামত করেন এবং অন্য একজন যদি সেই একই কাজ সময়মত এবং নিয়মমাফিক করে তবে আপনার থেকে অপর ব্যক্তিটি অবশ্যই একধাপ এগিয়ে থাকবে। তাই সময় এবং রুটিন মোতাবেক কাজ করার চেষ্টা করুন। এটি আপনাকে সময়মত এবং সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে সহায়তা করবে। এবং একসাথে অনেক কাজ জমে যাওয়ার মত সমস্যাও সৃষ্টি হবেনা। পাশাপাশি সিনিয়রদের কাছে আপনার জন্য একটি আলাদা মূল্যায়ন তৈরি হবে।
5. আত্মবিশ্বাস রাখুন
আমাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো আমাদের আত্মবিশ্বাস। যার মাঝে আত্মবিশ্বাস রয়েছে, সে যেকোনো কঠিন কাজকেও সহজভাবে সমাধান করতে পারে। তাই নিজেকে বিশ্বাস করুন। যেকোনো কাজে ভয় না পেয়ে তা সমাধান করার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে সাহায্য নিন। লক্ষ্য নির্ধারন করুন এবং সেই লক্ষ্য পুরনে কাজ করুন। দিনশেষে সেই কাজের হিসেব নিজেকেই দিন। যেকোনো পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার মত ক্ষমতা অর্জন করুন। বিশ্বাস রাখুন যে, আপনিই পারবেন। আর এই বিশ্বাসই আপনাকে সফলতার শিকর থেকে শিখরে নিয়ে যাবে।
কথার থেকে কাজকে বেশি প্রাধান্য দিন
আমরা সবাই কুসুমকুমারী দাশের বিখ্যাত কবিতা “আদর্শ ছেলে”র মূল লাইন, “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।” এই লাইন দুটির সাথে পরিচিত। কিন্তু এই লাইনটিকে বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত করতে পেরেছে কতজন? আপনার ক্যারিয়ারে এই লাইনটিকেই মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করুন। যেকোনো জায়গায় কথার থেকে কাজের প্রতি অধিক প্রাধান্য দিন। আপনার কাজকেই আপনার কথা হিসেবে প্রেজেন্ট করুন। নিশ্চয়ই সফলতা আপনার কাছে ধরা দেবে।
অতিরিক্ত কিছু দক্ষতা বর্তমান সময়ে কোন বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত রয়েছে সেই সম্পর্কে ধারণা রাখুন। রিসার্চ করুন এবং এর সমাধান খুঁজে বের করুন। এটি আপনাকে আপনার কর্মক্ষেত্রে অনেক বেশি সহায়তা করতে পারে। পাশাপাশি সহকর্মীদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করুন। সব সময় ইতিবাচক থাকুন। নেতিবাচক ধারণা আপনাকে আপনার লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে নিয়ে যেতে পারে। তাই সে ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। অহেতুক অভিযোগ করা বাদ দিন। এই ছোট ছোট কিছু অভ্যাস আপনাকে আপনার ক্যারিয়ারে সফল হতে সাহায্য করতে পারে। তাই আপনার একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো নয় অথবা প্র্যাকটিকাল নলেজ নেই এই নিয়ে আফসোস না করে এই অভ্যাসগুলো গড়ে তুলুন। ইনশাআল্লাহ সফলতা আসবেই।
শেষ কথা
ক্যারিয়ারে সফলতা সবাই পেতে চায়। এবং ব্যক্তিভেদে প্রায় সকলেই সফল হওয়ার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পথ অনুসরণ করে। তবুও প্রায় প্রতিটি সফল ব্যক্তির মধ্যে একটি কমন বিষয় লক্ষ্য করা যায় এবং তা হল, তারা প্রতিদিনই কিছু না কিছু ভালো অভ্যাস অনুসরণ করে এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করে। প্রতিদিন একই রুটিন মেনে চলার কারণে সময় ব্যবস্থাপনার উপর প্রভাব পড়ে এবং এনে দেয় কাঙ্খিত সাফল্য। তাই নিজের জন্য একটি রুটিন তৈরি করুন এবং সেটি প্রতিদিন অনুসরণ করুন। পাশাপাশি উপরোক্ত দক্ষতাগুলোর অভ্যাস গড়ে তুলুন। সেগুলো আপনার কর্মজীবনে ব্যবহার করুন। যে পরিস্থিতিই আসুক না কেন কখনো হতাশ হবেন না। উপরোক্ত দক্ষতা গুলো থাকলে আপনি সমস্ত বাধা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবেন।
পরিশেষে বলা যায়, একজন ভালো কর্মী হওয়ার আগে অবশ্যই একজন ভালো মানুষ হওয়া অত্যাধিক জরুরী। তাই সর্বোপরি নিজেকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করুন।